পাতা:পথের দাবী - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/১৫১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

দাঁড়াইয়াছে, সে-দেশের ও এ-দেশের শ্রমিকগণের মধ্যে সুনীতি ও দুর্নীতির তুলনামূলক আলোচনা করিলে কি দেখা যায় এবং সংসারে লাভ-ক্ষতির পরিমাণ তাহাতে কোথায় নির্দ্দিষ্ট হইয়াছে ইত্যাদি সংগ্রহমালার কোথাও না খেই হারাইয়া যায় এই ভয়ে সে আপনাকে আপনি বার বার সতর্ক করিল। তাহার স্মরণশক্তি তীক্ষ্ণ ছিল, বক্তৃতার মাঝখানে হঠাৎ যে ভুলিয়া যাইবে না, অনেকগুলা এক্‌জামিন ভাল করিয়া পাশ করার ফলে এ ভরসা তাহার ছিল। সুতরাং মুখ দিয়া তাহার এই সকল নিরতিশয় সারগর্ভ বাক্যধারা কখনো বা উচ্চসপ্তকে, কখনো বা গম্ভীর খাদে, কখনো বা হুঙ্কার শব্দে গর্জ্জিয়া গর্জ্জিয়া এক সময়ে যখন সমাপ্ত হইবে তখন বিপুল শ্রোতৃমণ্ডলীর করতালিধ্বনি হয়ত বা সহজে থামিতেই চাহিবে না। সুমিত্রার প্রসন্ন দৃষ্টি সে স্পষ্ট দেখিতে লাগিল। আর ভারতী! এইটুকু সময়ে এতখানি জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা সে যে কি করিয়া আয়ত্ত করিল ইহারই আনন্দিত বিস্ময়ে মুখ তাহার সমুজ্জ্বল ও চোখের দৃষ্টি সজল হইয়া একমাত্র তাহার মুখের ’পরে নিপতিত হইয়াছে, কল্পনায় প্রত্যক্ষবৎ দেখিতে পাইরা অপূর্ব্বর শিরার রক্ত সবেগে বহিতে লাগিল। তাহার দ্রুত পদক্ষেপের সমান তালে পা ফেলিয়া চলা তলওয়ারকরের পক্ষে আজ যেন দুরূহ হইয়া পড়িল। তাহারা মাঠে পৌঁছিয়া দেখিল তথায় তিল ধারণের স্থান নাই, লোক জমিয়াছে যে কত তাহার সংখ্যা হয় না। সেদিনকার বক্তা হিসাবে অপূর্ব্বকে যাহারা চিনিতে পারিল তাহারা পথ ছাড়িয়া দিল, যাহারা চিনিত না তাহারও দেখা-দেখি সরিয়া দাঁড়াইল। বিপুল জনতার মাখানে মাচা বাঁধা। ডাক্তার আজিও ফিরেন নাই, তাই শুধু তিনি ছাড়া পথের দাবীর সকল সভাই উপনীত। বন্ধুকে সঙ্গে করিয়া কোনমতে ভিড় ঠেলিয়া অপূর্ব্ব তথায় আসিয়া উপস্থিত হইল। মাচার উপরে একখান। বেঞ্চ তখনও খালি ছিল, চোখের ইঙ্গিতে নির্দ্দেশ করিয়া সুমিত্রা সেইখানে তাহাদের অভ্যর্থনা করিলেন। মাচার পুরোভাগে দাঁড়াইয়া পাঞ্জাবী একজন অত্যন্ত ভয়ঙ্কর বক্তৃতা দিতেছিল, বোধ করি সে জবাব-পাওয়া মিস্ত্রী কিংবা এমনি কিছু একটা হইবে, অপূর্ব্বদের অভ্যাগমে ক্ষণকাল মাত্র বাধা পাইয়া পুনশ্চ দ্বিগুণ তেজে চীৎকার করিতে লাগিল। ভাল বক্তার কাছে জনতা যুক্তিতর্ক চাহে না, যাহা মন্দ তাহা কেন মন্দ এ খবরে তাহাদের আবশ্যক হয় না, শুধু মন্দ যে কত অসংখ্য বিশেষণ যোগে ইহাই শুনিয়া তাহারা চরিতার্থ হইয়া যায়। পাঞ্জাবী মিস্ত্রীর প্রচণ্ড বলার মধ্যে বোধ করি এই গুণটাই পর্য্যাপ্ত পরিমাণে বিদ্যমান থাকায় শ্রোতার দল যে কিরূপ চঞ্চল হইর। উঠিয়াছিল তাহাদের মুখ দেখিয়াই তাহা বুঝা যাইতেছিল।

 অকস্মাৎ কি যেন একটা ভয়ানক বিঘ্ন ঘটিল। মাঠের কোন এক প্রান্ত হইতে অগণিত চাপা-কণ্ঠে সন্ত্রাস কলরব উঠিল এবং পরক্ষণেই দেখা গেল বহু লোক

১৪৭