পাতা:পথের দাবী - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/১৫৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

 এই পীড়িত রমণীর সহজ শান্ত হাসিটুকুর কাছে সাহেব মনে মনে বোধ হয় লজ্জা পাইল, অল্ রাইট। আপনাকে সাবধান করে দিলাম। ঘড়ি খুলিয়া কহিল, মিটিং বন্ধ করবার আমার হুকুম আছে, কিন্তু ভেঙ্গে দেবার নেই। দশ মিনিট সময় দিলাম, দু’চার কথায় এদের শান্তভাবে যেতে বলে দিন। আর কখনো যেন এরূপ না হয়।

 কিছুদিন হইতে প্রায় উপবাসেই সুমিত্রার দিন কাটিতেছিল। সকলের নিষেধ সত্ত্বেও সে আজ সামান্য একটু জ্বর লইয়াই সভায় উপস্থিত হইয়াছিল, কিন্তু এখন ক্লান্তি ও অবসাদ তাহাকে যেন আচ্ছন্ন করিয়া ধরিল। চৌকির পিঠে মাথা হেলান দিয়া সে অস্ফুটে ডাকিয়া কহিল, অপূর্ব্ববাবু, দশ মিনিট মাত্র সময় আছে,—হয়ত তাও নেই। চীৎকার করে সকলকে জানিয়ে দিন সঙ্ঘবদ্ধ না হ’লে এদের আর উপায় নেই। কারখানার মালিকেরা আজ আমাদের যে অপমান করলে মানুষ হলে এরা যেন তার শোধ নেয়। বলিতে বলিতে তাহার দুর্ব্বল কণ্ঠ ভাঙ্গিয়া পড়িল, কিন্তু সভানেত্রীর এই আদেশ শুনিয়া অপূর্ব্বর সমস্ত মুখ ফ্যাকাশে হইয়া উঠিল। বিহ্বলনেত্রে সুমিত্রার প্রতি চাহিয়াই কহিল, উত্তেজিত করা কি বে-আইনি হবে না?

 সুমিত্রা বিস্মিত মৃদুকণ্ঠে বলিল, পিস্তলের জোরে সভা ভেঙ্গে দেওয়াই কি আইনসঙ্গত? বৃথা রক্তপাত আমি চাইনে, কিন্তু এই কথাটা সকল শক্তি দিয়ে আপনি শুনিয়ে দিন আজকের অপমান শ্রমিকেরা যেন কিছুতে না ভোলে।

 পথের দাবীর অন্য চার-পাঁচজন পুরুষ সভ্য যাহারা মঞ্চের পরে আসীন ছিল চেহারা দেখিয়াই মনে হয় তাহারা সামান্য এবং তুচ্ছ ব্যক্তি। হয়ত কারিকর কিংবা এমনি কিছু হইবে। অপূর্ব্ব নূতন হইলেও সমিতির শিক্ষিত এবং বিশিষ্ট সভ্য। এতবড় জনতাকে সম্বোধন করিবার ভার তাই তাহার প্রতি পড়িয়াছে। অপূর্ব্ব শুষ্ককণ্ঠে কহিল, আমি ত হিন্দী ভাল জানিনে।

 সুমিত্রা কথা কহিতে পারিতেছিল না, তথাপি কহিল, যা জানেন তাতেই দু’কথা বলে দিন অপূর্ব্ববাবু, সময় নষ্ট করবেন না।

 অপূর্ব্ব সকলের মুখের দিকে চাহিয়া দেখিল। ভারতী মুখ ফিরাইয়া ছিল, তাহার অভিমত জানা গেল না, কিন্তু জানা গেল সর্দ্দার-গোরার মনে ভাব। তাহার সহিত অত্যন্ত কাছে অত্যন্ত স্পষ্ট এবং অত্যন্ত কঠিন চোখা-চোখি হইল। বলিবার জন্য অপূর্ব্ব উঠিয়া দাঁড়াইল, তাহার ঠোঁট নড়িতে লাগিল, কিন্তু সেই কম্পিত ওষ্ঠাধর হইতে বাঙলা ইংরাজি হিন্দী কোন ভাষাই ব্যক্ত হইল না। কেবল একান্ত পাণ্ডুর মুখের ’পরে ব্যক্ত যাহা হইল, তাহা আর যাহারই হোক পথের দাবীর সভ্যদের জন্যে নহে।

 তলওয়ারকর উঠিয়া দাঁড়াইল। সুমিত্রাকে লক্ষ্য করিয়া কহিল, আমি বাবুজির বন্ধু। আমি হিন্দী জানি। আদেশ পাই ত ওর বক্তব্য আমি চেঁচিয়ে সকলকে

১৪৯