পাতা:পথের দাবী - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/১৫৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

লক্ষ্য করিয়া নিজেও উত্তেজিত হইয়া উঠিল। তাহার রিস্টওয়াচের প্রতি বক্তার দৃষ্টি আকর্ষণ করিয়া বলিল, আর পাঁচ মিনিট মাত্র সময় আছে, আপনি শেষ করুন।

 তলওয়ারকর কহিল, শুধু পাঁচ মিনিট! তার বেশী এক মুহূর্ত্তও নয়! তবুও এই অমুল্য ক’টি মিনিট আমি কিছুতেই ব্যর্থ হতে দেব না। ভাই বঞ্চিতের দল! তোমাদের কাছে আমার মিনতি—আমাদের তোমরা অবিশ্বাস কোরো না। শিক্ষিত বলে, ভদ্র-বংশের বলে, কারখানায় দিন-মজুরি করিনি বলে আমাদের সংশয়ের দৃষ্টিতে দেখে নিজেদের সর্ব্বনাশ তোমরা নিজেরাই করো না। তোমাদের ঘুম ভাঙাবার প্রথম শঙ্খধ্বনি সর্ব্বদেশে সর্ব্বকালে আমরাই করে এসেচি। আজ হয়ত না বুঝতেও পার, কিন্তু নিশ্চয়ই জেনো এই পথের দাবীর চেয়ে বড় বন্ধু এদেশে তোমাদের আর কেউ নেই। তাহার কণ্ঠ শুষ্ক ও কঠিন হইয়া আসিতেছিল, তথাপি প্রাণপণে চীৎকার করিয়া কহিতে লাগিল, আমি বহুদিন তোমাদের মধ্যে কাজ করে এসেছি, আমাদের তোমরা চেনো না, কিন্তু আমি তোমাদের চিনি। যাদের তোমরা মনিব বলে জানো, একদিন আমি তাদেরই একজন ছিলাম। তারা কিছুতেই তোমাদের মানুষ হ’তে দেবে না। কেবল পশুর মত করে রেখেই তোমাদের মনুষ্যত্বের অধিকার তারা আটকে রাখতে পারে, আর কোন মতেই না—এই কথাটা তোমাদের আজ না বুঝলেই নয়। তোমরা অসাধু, তোমরা উচ্ছৃঙ্খল, তোমরা ইন্দ্রিয়াশক্ত— তাদের মুখ থেকে এই সকল অপবাদই তোমরা চিরদিন শুনে এসেচ। তাই, যখনই তোমরা দাবী জানিয়েচ, তখনই তোমাদের সকল দুঃখ-কষ্টের মুলে তোমাদের অসংযত চরিত্রকে দায়ী করে তারা তোমাদের সর্ব্বপ্রকার উন্নতিকে নিবারিত করে এসেচে। কেবল এই মিথ্যেই তোমাদের তারা অনুক্ষণ বুঝিয়ে এসেচে ভাল না হলে কারও উন্নতিই কোনদিন হতে পারে না। কিন্তু, আজ আমি তোমাদের অসঙ্কোচে একান্ত অকপটে জানতে চাই ঐ উক্তি তাদের কখনই সম্পূর্ণ সত্য নয়! তোমাদের চরিত্রই শুধু তোমাদের অবস্থার জন্য দায়ী নয়; তোমাদের এই প্রবঞ্চিত হীন অবস্থাও তোমাদের চরিত্রের জন্য দায়ী। তাদের অসত্যকে আজ তোমাদের নির্ভয়ে প্রতিবাদ করতেই হবে। প্রবলকণ্ঠে তোমাদের ঘোষণা করতেই হবে কেবল টাকাই সবটুক নয়। বলিতে বলিতে তাহার নীরস কণ্ঠ অত্যন্ত প্রখর হইয়া উঠিল, কহিল, বিনাশ্রমে সংসারে কিছুই উৎপন্ন হয় না—তাই, শ্রমিকও ঠিক তোমাদেরই মত মালিক,—ঠিক তোমাদেরই মত সকল বস্তু, সকল কারখানার অধিকারী। এমনি সময়ে কে একজন পাঞ্জাবী ভদ্রলোক সর্দ্দার-গোরার কানে কানে কি একটা কথা বলিতেই তাহার রক্ত-চক্ষু জ্বলন্ত অঙ্গারের মত উগ্র হইয়া উঠিল। সে গর্জ্জন করিয়া বলিল, স্টপ! এ চলবে না। এতে শান্তি ভঙ্গ হবে।

১৫১