পাতা:পথের দাবী - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/১৫৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

 অপূর্ব্ব চমকিয়া উঠিল। রামদাসের জামার খুঁট ধরিয়া টানাটানি করিতে লাগিল,—থামো, রামদাস থামো। এই নিঃসহায় নির্বান্ধব বিদেশে যে তোমার স্ত্রী আছে,—তোমার ছোট্ট একফোঁটা মেয়ে আছে।

 রামদাস কর্ণপাতও করিল না। চীৎকার করিয়া কহিতে লাগিল, এরা অন্যায়কারী! এরা ভীরু! সত্যকে এরা কোনমতেই তোমাদের শুনতে দিতে চায় না! কিন্তু এরা জানে সত্যকে গলা টিপে মারা যাবে না। সে চিরঞ্জীবী! সে অমর! গোরা ইহার অর্থ বুঝিল না। কিন্তু অকস্মাৎ সহস্র লোকের সর্ব্বাঙ্গ হইতে ঠিকরিয়া আসিয়া যেন তীক্ষ্ণ উত্তাপের ঝাঁঝ তাহার মুখে লাগিল। সে হুঙ্কার দিয়া উঠিল, এ চলবে না। এ রাজদ্রোহ!

 চক্ষের পলকে পাঁচ-ছয়জন ঘোড়া হইতে লাফাইয়া পড়িয়া রামদাসের দুই হাত ধরিয়া তাহাকে সবলে টানিয়া নীচে নামাইল। তাহার দীর্ঘ দেহ ঘোড়া ও ঘোড়সওয়ারের মাঝখানে এক মুহূর্ত্তে অন্তর্হিত হইল, কিন্তু তীক্ষ্ণ তীব্র কণ্ঠস্বর তাহার কিছুতেই চাপা পড়িল না—এই বিক্ষুব্ধ বিপুল জনতার একপ্রান্ত হইতে অপরপ্রাপ্ত পর্য্যন্ত ধ্বনিত হইতে লাগিল,—ভাইসকল, কখনো হয়ত আর আমাকে দেখরে না, কিন্তু মানুষ হয়ে জন্মাবার মর্য্যাদা যদি না মনিবের পায়ে নিঃশেষে বিলিয়ে দিয়ে থাকো ত এত বড় উৎপীড়ন, এত বড় অপমান তোমরা সহ্য ক’রো না।

 কিন্তু তাহার কথা শেষ না হইতেই যেন দক্ষযজ্ঞ বাধিয়া গেল। ঘোড়া ছুটিল, চাবুক চলিল এবং অবমানিত অভিভূত সমস্ত শ্রমিকের দল উর্দ্ধশাসে পলায়ন করিতে কে যে কাহার ঘাড়ে পড়িল এবং কে যে কাহার পদতলে গড়াইতে লাগিল তাহার ঠিকানা রহিল না।

 জনকয়েক দলিত পিষ্ট আহত লোক ছাড়া সমস্ত মাঠ জনশূন্য হইতে বিলম্ব ঘটিল না। কোন মতে খোঁড়াইতে খোঁড়াইতে যাহারা তখনও চলিয়াছিল তাহাদেরই প্রতি একদৃষ্টে চাহিয়া সুমিত্রা স্তব্ধ হইয়া রহিলেন এবং তাহারই অনতিদূরে বসিয়া অপূর্ব্ব ও আর একজন নির্ব্বাক নতমুখে তেমনি বিমূঢ়ের ন্যায় স্থির হইয়া রহিল।

 যে ব্যক্তি গাড়ি ডাকিতে গিয়াছিল, মিনিট-দশেক পরে গাড়ি লইয়া আসিলে সুমিত্রা নিঃশব্দে ভারতীর হাত ধরিয়া ধীরে ধীরে গিয়া তাহাতে উপবেশন করিলেন। নিজে হইতে কথা না কহিলে তাঁহার চিন্তার ব্যাঘাত করিতে কেহ তাঁহাকে ব্যর্থ প্রশ্ন করিত না। বিশেষতঃ আজ তিনি অসুস্থ, শ্রান্ত এবং উৎপীড়িত।

 ভারতী ফিরিয়া আসিয়া কহিল, চলুন।

 অপূর্ব্ব মুখ তুলিয়া চাহিল, ক্ষণকাল কি যেন চিন্তা করিয়া জিজ্ঞাসা করিল, কোথায় আমাকে যেতে বলেন?

১৫২