পাতা:পথের দাবী - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/১৭০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

অন্তর্গূঢ় বেদনা একেবারে ক্ষিপ্ত হইয়া উঠিবে এই কথা নিঃসংশয়ে অনুভব করিয়া ভারতীর ক্ষুব্ধ চিত্ত শঙ্কায় পূর্ণ হইয়া যাইত।

 ডাক্তার আরাম কেদারায় ভাল করিয়া হেলান দিয়া শুইয়া সুদীর্ঘ পদদ্বয় সুমুখের টেবিলের উপর প্রসারিত করিয়া দিয়া সহসা মহা আরামের নিশ্বাস ফেলিয়া বলিলেন, আঃ—

 ভারতী বিস্ময়াপন্ন হইয়া কহিল, শুলেন যে বড়?

 ডাক্তার রাগ করিয়া বলিলেন, কেন আমি কি ঘোড়া যা একটু শুলেই বেতো হয়ে যাবো? আমার ঘুম পাচ্চে,—তোমাদের মত আমি দাঁড়িয়ে ঘুমতে পারিনে।

 ভারতী বলিল, দাঁড়িয়ে ঘুমতে আমরাও পারিনে। কিন্তু কেউ যদি এসে বলে আপনি দৌড়তে দৌড়তে ঘুমতে পারেন, আমি তাতেও আশ্চর্য হইনে; আপনার এই দেহটা দিয়ে সংসারে কি যে না হতে পারে তা কেউ জানে না কিন্তু সময় হল যে; এখুনি না বেরুলে গাড়ি চলে যাবে যে!

 যাক গে।

 যাক গে কি রকম?

 উঃ— ভয়ানক ঘুম পাচ্চে ভারতী, চোখ চাইতে পারচিনে। এই বলিয়া ডাক্তার দুই চক্ষু মুদ্রিত করিলেন।

 কথা শুনিয়া ভারতী পুলকিত চিত্তে অনুভব করিল কেবল তাহারই অনুরোধে আজ তাঁহার যাওয়া স্থগিত রহিল। না হইলে শুধু ঘুম কেন; বজ্রাঘাতের দোহাই দিয়াও তাঁহার সঙ্কল্পে বাধা দেওয়া যায় না। কহিল, আর ঘুমই যদি সত্যি পেয়ে থাকে ওপরে গিয়ে শুয়ে পড়ুন না।

 ডাক্তার চোখ মুদিয়াই প্রশ্ন করিলেন, তোমার নিজের উপায় হবে কি? অপূর্ব্বর পথ চেয়ে সারারাত বসে কাটাবে?

 ভারতী বলিল, আমার বয়ে গেছে। পাশের ছোট ঘরে বিছানা করে এখনি গিয়ে শুয়ে ঘুমবো।

 ডাক্তার কহিলেন, রাগ করে শোয়া যেতে পারে, কিন্তু রাগ করে ঘুমনো যায় না বিছানায় পড়ে ছট্‌ফট্ করার মত শাস্তি আর নেই। তার চেয়ে খুঁজে আনো গে,—আমি কারও কাছে প্রকাশ করব না।

 ভারতীর মুখ আরক্ত হইয়া উঠিল, কিন্তু সে লজ্জা ধরা পড়িল না। কারণ, ডাক্তার চোখ বুজিয়াই ছিলেন। তাঁহার নিমীলিত চোখের প্রতি চোখ রাখিয়া ভারতী মুহূর্ত্তকয়েক মৌন থাকিয়া আপনাকে সংবরণ করিয়া লইয়া আস্তে আস্তে

১৬৬