পাতা:পথের দাবী - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/১৭১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

জিজ্ঞাসা করিল, আচ্ছা ডাক্তারবাবু, বিছানায় পড়ে ছট্‌ফট্ করার মত শাস্তি আর নেই এ আপনি জানলেন কি করে?

 ডাক্তার উত্তর দিলেন, লোকে বলে তাই শুনি।

 নিজে থেকে কিছুই জানেন না?

 ডাক্তার চোখ মেলিয়া কহিলেন, আরে ভাই, আমাদের মত দুর্ভাগাদের শুতে বিছানাই মেলে না, তায় আবার ছট্‌ফট্ করা! এতখানি বাবুয়ানার কি ফুরসৎ আছে? এই বলিয়া তিনি মুচকিয়া কাসিলেন।

 ভারতী হঠাৎ প্রশ্ন করিল, আচ্ছা ডাক্তারবাবু, সবাই যে বলে আপনার দেহের মধ্যে রাগ নেই এ কি কখনো সত্যি হতে পারে?

 ডাক্তার বলিলেন, সত্যি? কখনো না কখনো না। লোকে মিথ্যে করে আমার বিরুদ্ধে গুজব রটায়, তারা আমাকে দেখতে পারে না।

 ভারতী হাসিয়া কহিল, কিংবা অত্যন্ত বেশি ভালবাসে বলেই হয়ত গুজব রটায়। তারা আরও বলে আপনার মান-অভিমান নেই, দয়া-মায়া নেই, বুকের ভেতরটা আগাগোড়া একেবারে পাষাণ দিয়ে গড়া।

 ডাক্তার কহিলেন, এও অত্যন্ত ভালবাসার কথা। তারপর?

 ভারতী কহিল, তারপর সেই পাষাণ স্তূপের মধ্যে আছে শুধু একটি বস্তু,—জননী জন্মভূমি। তার আদি নেই, অন্ত নেই, ক্ষয় নেই, ব্যয় নেই,—তার ভয়ানক চেহারা আমাদের চোখে পড়ে না বলেই আপনার কাছে কাছেই থাকতে পারি, নইলে,—বলিতে বলিতে সে অকস্মাৎ এক মুহূর্ত্ত থামিয়া কহিল, কি রকম জানেন ডাক্তারবাবু, সুমিত্রাদিদিকে নিয়ে আমি সেদিন বর্ম্মা অয়েল কোম্পানীর কারখানা ঘরের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম, সেদিন তাদের নতুন বয়লার পরীক্ষা হচ্ছিল, অনেক লোক ভিড় করে তামাসা দেখছিল। কালো পাহাড়ের মত একটা প্রকাণ্ড জড়পিণ্ড, কিন্তু, জড়পিণ্ডের বেশি সে আর কিছুই নয়। হঠাৎ তার একটা দরজা খুলে যেতে মনে হল যেন গর্ভেতে তার অগ্নির প্লাবন বয়ে যাচ্চে। সেখানে এই পৃথিবীটাকেও তাল করে ফেলে দিলে যেন নিমেষে ভস্মসাৎ করে দেবে। শুনলাম সে একাই নাকি এই বিরাট কারখানা চালিয়ে দিতে পারে। দরজা বন্ধ হ’ল, আবার সেই শান্ত জড়পিণ্ড, ভিতরের কোন প্রকাশই বাইরে নেই। সুমিত্রাদিদির মুখ দিয়ে গভীর দীর্ঘ নিশ্বাস পড়ল; বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, কি দিদি? সুমিত্রা বললেন, এই ভয়ানক যন্ত্রটাকে মনে রেখো ভারতী, তোমাদের ডাক্তারবাবুকে চিনতে পারবে। এই তাঁর সত্যকার প্রতিমূর্ত্তি। এই বলিয়া সে ক্ষণকাল তাঁহার মুখের প্রতি চাহিয়া রহিল।

১৬৭