পাতা:পথের দাবী - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/১৭৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

একটিবার মাত্র চোখ মেলে চাইলেন। তারপর আস্তে আস্তে বললেন, ছিঃ—মেয়েদের মত এইসব গরু ভেড়া ছাগলের সঙ্গে গলা মিশিয়ে তুই আর কাঁদিসনে শৈল। কিন্তু রাজত্ব করার লোভে যারা সমস্ত দেশটার মধ্যে মানুষ বলতে আর একটা প্রাণীও রাখেনি তাদের তুই জীবনে কখনো ক্ষমা করিসনে। এই কটা কথা, এর বেশী আর একটা কথাও তিনি বলেননি। ঘৃণায় একটা উঃ আঃ পর্য্যন্ত তাঁর মুখ দিয়ে শেষ পর্য্যন্ত বার হল না, এই অভিশপ্ত পরাধীন দেশ চিরদিনের জন্য ছেড়ে চলে গেলেন। কেবল আমিই জানি ভারতী, কত মস্ত বড় প্রাণ সেদিন বার হয়ে গেল।

 ভারতী নীরবে স্থির হইয়া রহিল। কবে কোন পল্লী অঞ্চলের এক দুর্ঘটনার কাহিনী। ডাকাতি উপলক্ষ্যে গোট-দুই অজ্ঞাত অখ্যাত লোকের প্রাণ গিয়াছে। জগতের বড় বড় বিরোধের দুঃসহ দুঃখের পাশে ইহা কি-ই বা! অথচ এই পাষাণে কি গভীর ক্ষতই না করিয়াছে! তুলনা ও গণনার দিক দিয়া দুর্ব্বলের দুঃখের ইতিহাসে এই হত্যার নিষ্ঠুরতা নিতান্ত অকিঞ্চিৎকর! এই বাঙলা দেশেই তে নিত্য কতলোক চোর-ডাকাতের হাতে মরিতেছে! কিন্তু এ কি শুধু তাই? ও পাথর কি এতটুকু আঘাতেই দীর্ণ হইয়াছে? ভারতী অলক্ষ্যে চাহিয়া দেখিল। এবং বিদ্যুৎশিক্ষা অকস্মাৎ অন্ধকার চিরিয়া যেমন করিয়া অদৃশ্য বস্তু টানিয়া বাহির করে, ঠিক তেমনি করিয়া এই পাথরের মুখের পরেই সে যেন সমস্ত অজ্ঞাত রহস্য চক্ষের পলকে প্রত্যক্ষ করিল। সে দেখিল, এই বেদনার ইতিহাসে মৃত্যু কিছুই নয়,—মরণ উহাকে আঘাত করে না, কিন্তু মর্ম্মভেদী আঘাত করিয়াছে ওই দুটো লোকের মৃত্যুর মধ্য দিয়া শৃঙ্খলিত, পদানত সমস্ত ভারতীয়ের উপায়বিহীন অক্ষমতা, আপন ভাইয়ের আসন্ন হত্যা নিবারণ করিবার অধিকারটুকু হইতেও সে বঞ্চিত—অধিকার আছে শুধু চোখ মেলিয়া নিঃশব্দে চাহিয়া দেখিবার। ভারতীর সহসা মনে হইল, সমস্ত জাতির এই সুদুঃসহ লাঞ্ছনা গ্লানি এই পাষাণের মুখের ’পরে যেন নিবিড় নিশ্ছিদ্র কালি লেপিয়া দিয়াছে।

 বেদনায় সমস্ত বুকের ভিতরটা ভারতীর আলোড়িত হইয়া উঠিল, কহিল, দাদা!

 ডাক্তার সবিস্ময়ে ঘাড় তুলিয়া কহিলেন, আমাকে ডাকচো?

 ভারতী বলিল, হাঁ তোমাকে। আচ্ছা, ইংরাজের সঙ্গে কি তোমার কখনো সন্ধি হতে পারে না?

 না। আমার চেয়ে বড় শত্রু তাদের আর নেই।

 ভারতী মনে মনে ক্ষুণ্ণ হইয়া বলিল, কারও শত্রুতা, কারও অকল্যাণ তুমি কামনা করতে পারো এ আমি ভারতেও পারিনে দাদা।

১৭১