পাতা:পথের দাবী - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/১৭৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

তাহারই মধ্য দিয়া পথ, বোধ করি কত যে বিষধর সর্প তথায় আশ্রয় লইয়া আছে তাহার ইয়ত্তা নাই।

 মস্ত হল ঘরের এককোণে উপরে উঠিবার সিঁড়ির মাঝে মাঝে কাঠ নাই, এই দিয়া ভারতী হীরার হাত ধরিয়া দ্বিতলে উঠিয়া সুমুখের বারান্দা পার হইয়া এতক্ষণে এত দুঃখের পরে নির্দ্দিষ্ট স্থানে আসিয়া উপস্থিত হইল। ঘরের মধ্যে চাটাই পাতা, একধারে গোটা-দুই মোমবাতি জ্বলিতেছে এবং তাহারই পার্শ্বে সভানেত্রীর আসনে বসিয়া সুমিত্রা! অপর প্রান্তে ডাক্তার বসিয়াছিলেন, তিনিই সস্নেহ কণ্ঠে ডাকিয়া কহিলেন, এসো ভারতী, আমার কাছে এসে বোস।

অজানা শঙ্কায় ভারতীর বুকের মধ্যে গুরু গুরু করিয়া উঠিল, মুখ দিয়া কথা বাহির হইল না, কিন্তু একটুখানি যেন দ্রুতপদেই সে কাছে গিয়া ডাক্তারের বুক ঘেঁসিয়া বসিয়া পড়িল। তাহার কাঁধের উপর বাঁ হাতখানি রাখিয়া যেন তিনি নিঃশব্দে তাহাকে ভরসা ছিলেন। হীরা সিং ঘরে ঢুকিল না, দ্বারের কাছে দাঁড়াইয়া রহিল। ভারতী চাহিয়া দেখিল যাহারা বসিয়া আছে পাঁচ-ছয়জনকে সে একেবারেই চেনে না। পরিচিতের মধ্যে ডাক্তার ও সুমিত্রা ব্যতীত রামদাস তলওয়ারকর ও কৃষ্ণ আইয়ার। একজন ভীষণাকৃতি লোককে সর্ব্বাগ্রেই চোখে পড়ে—পরণে তাহার গেরুয়া রঙের আলখাল্লা এবং মাথায় সুবৃহৎ পাগড়ী। মুখখানা বড় হাঁড়ির মত গোলাকার এবং দেহ গণ্ডারের মত স্থূল, মাংসল ও কর্কশ। ভাঁটার যত চোখের উপর ভ্রূর চিহ্নমাত্র নাই, কঠিন শলার মত গোঁফের রোম বোধ করি দূর হইতে গনিয়া বলা যায়, রঙ তামার মত, লোকটা যে অনার্য্য মোঙ্গলজাতীয় দৃষ্টিপাতমাত্র সংশয় থাকে না। এই বীভৎস ভয়ানক লোকটার প্রতি ভারতী চোখ তুলিয়া চাহিতেই পারিল না। মিনিট-দুই সমস্ত ঘরটা একেবারে স্তব্ধ হইয়া রহিল। তখন সুমিত্রা ডাকিয়া কহিলেন, ভারতী, তোমার মনের ভাব আমি জানি, তাই তোমাকে ডেকে এনে দুঃখ দেবার আমার ইচ্ছাই ছিল না, কিন্তু ডাক্তার কিছুতেই হতে দিলেন না। অপূর্ব্ববাবু কি করেচেন জানো?

 ভারতীর নিভৃত হৃদয়ে এমনি কি যেন একটা তাহাকে সারাদিন ধরিয়া বলিতে ছিল। তাহার কণ্ঠ শুষ্ক ও মুখ বিবর্ণ হইয়া উঠিল, শুধু সে নীরবে ফ্যাল্ ফ্যাল্ করিয়া চাহিয়া রহিল।

 সুমিত্রা কহিলেন, বোথা কোম্পানী রামদাসকে আজ ডিসমিস করেচে। অপূর্ব্বরও সেই দশা হতো, শুধু পুলিশ কমিশনারের কাছে আমাদের সমস্ত কথা অকপটে ব্যক্ত করেই তাঁর চাকরিটা বেঁচেছে। মাইনে ত কম নয়, বোধহয় পাঁচশো।

 রামদাস ঘাড় নাড়িয়া বলিল, হাঁ।

১৭৪