পাতা:পথের দাবী - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/১৮০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

চোখে নির্ব্বোধের মত চাহিয়া দেখিতেছিল। এইটুকু মাত্র সে হৃদয়ঙ্গম করিয়াছিল, অপূর্ব্ব গুরুতর অপরাধ করিয়াছে এবং এই লোকগুলি তাহাকে বধ করিতে কৃতসঙ্কল্প হইয়াছে। এদেশে জীবন তাহার সঙ্কটাপন্ন। কিন্তু এ সঙ্কট যে কিরূপ আসন্ন হইয়াছে, সে তাহার কিছুই বুঝে নাই। সুমিত্রার ইঙ্গিতে একজন উঠিয়া বাহির হইয়া গেল এবং মিনিট-দুই পরে যে দৃশ্য ভারতীর চোখে পড়িল, তাহা অতি বড় দুঃস্বপ্নের অতীত। এই লোকটা অপূর্ব্বকে লইয়া ঘরে ঢুকল, তাহার দুই হাত পিঠের দিকে শক্ত করিয়া দড়ি দিয়া বাঁধা এবং কোমর হইতে মস্ত ভারি একখণ্ড পাথর বুলিতেছে। মুহুর্ত্তের জন্য চৈতন্য হারাইয়া ভারতী ডাক্তারের দেহের উপর ঢলিয়া পড়িল। কিন্তু সকলের দৃষ্টি তখন অপূর্ব্বর প্রতি নিবদ্ধ বলিয়াই শুধু একজন ভিন্ন এ খবর আর কেহ জানিতে পারিল না!

 ভারতী এখানে আসিবার পূর্ব্বেই অপূর্ব্বর এজাহার লওয়া শেষ হইয়া গিয়াছিল। সে অস্বীকার কিছুই করে নাই। আফিসের বড়সাহেব ও পুলিশের বড় সাহের, এই দুই সাহেব মিলিয়া তাহার নিকট হইতে সমস্ত তথ্যই জানিয়া লইয়াছে, তাহা সে বলিয়াছে, কিন্তু কিসের জন্য সে দলের এবং দেশের এত বড় শত্রুতা সাধন করিল তাহা সে এখনও জানে না।

 আজ বেলা বারোটার মধ্যেই রামদাস এ-সংবাদ সুমিত্রার কর্ণগোচর করে। দণ্ড স্থির হইয়া যায় এবং যে উপায়ে অপূর্ব্বকে হস্তগত করা হইয়াছে তাহা সংক্ষেপে এইরূপ—

 আফিসের ছুটির পরে আজ অপূর্ব্ব হাঁটিয়া বাসায় যাইতে সাহস করিবে না তাহা নিশ্চয় অনুমান করিয়া তাহাদের ভাড়াটে গাড়িখানা হীরার সাহায্যে আফিসের গেটের কাছে রাখা হয়। এই ফাঁদে অপূর্ব্ব সহজেই পা দেয়। কিছুদূর আসিয়া গাড়োয়ান জানায় যে মস্ত একটা রোলার ভাঙ্গিয়া গলির মোড় বন্ধ হইয়া আছে, ঘুরিয়া যাইতে হইবে। অপূর্ব্ব স্বীকার করে। ইহার পরেই বোধ হয় সে অন্যমনস্ক হইয়া পড়িয়াছিল, কিন্তু ঘণ্টাখানেক পরে যখন চৈতন্য হয়, তখন হীরা সিং গাড়ির মধ্যে প্রবেশ করিয়া পিস্তল দেখাইয়া অনায়াসে এখানে লইয়া আসে।

 সুমিত্রা ডাকিয়া কহিলেন, অপূর্ব্ববাবু, আমরা আপনাকে ডেথ্ সেনটেন্স দিলাম। আর্ কিছু আপনার বলার আছে?

 অপূর্ব্ব ঘাড় নাড়িয়া জানাইল, না। কিন্তু তাহার মুখ দেখিয়া মনে হইল সে কিছুই বুঝে নাই।

 ডাক্তার এতক্ষণ কোন কথাই প্রায় বলেন নাই, পিছনে চাহিয়া কহিলেন, হীরা, তোমার পিস্তলটা কই?

১৭৬