পাতা:পথের দাবী - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/১৯০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

২১

 পরদিন অপরাহ্ণবেলায় সকল কথা, সমস্ত ঘটনা পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে বিবৃত করিয়া ভারতী পরিশেষে কহিল, অপূর্ব্ববাবু যে মস্ত লোক এ ভুল আমি একদিনও করিনি, কিন্তু তিনি যে এত সামান্য, এত তুচ্ছ—এ ধারণাও আমার ছিল না।

 ভারতীর ঘরে খাটের উপর বসিয়া সব্যসাচী ডাক্তার একখানা বইয়ের পাতা উল্টাইতেছিলেন, তাহার প্রতি চাহিয়া গম্ভীর মুখে কহিলেন, কিন্তু আমি জানতাম। লোকটা এত তুচ্ছ না হলে কি এতবড় ভালবাসা তোমার এত তুচ্ছ কারণেই যায়? যাক বাঁচা গেল ভাই, কাকে কি ভেবে মিথ্যে দুঃখ পাচ্ছিলে বইত নয়!

 ইতস্ততঃ বিক্ষিপ্ত জিনিসপত্র, বিশেষ করিয়া মেঝের উপরে ছড়ানো পুস্তকের রাশি, চাহিয়া দেখিলেই বুঝা যায় এ-ঘরে ইতিপূর্ব্বে পুলিশ তদন্ত হইয়া গেছে। সেইগুলা সব গুছাইতে গুছাইতে ভারতী কথা কহিতেছিল। সে হাতের কাজ বন্ধ করিয়া সবিস্ময়ে চোখ তুলিয়া বলিল, তুমি তামাসা করচ দাদা?

 না।

 নিশ্চয়।

 ডাক্তার কহিলেন, আমার মত ভয়ানক লোক, যে বোমা পিস্তল নিয়ে কেবল মানুষ খুন করে বেড়ায়, তার মুখে তামাসা?

 ভারতী কহিল, আমি ত বলিনে, তুমি মানুষ খুন করে বেড়াও। ও-কাজ তুমি পারোই না। কিন্তু তামাসা ছাড়া কি হতে পারে বল ত? ঘণ্টা দুই-তিনের মধ্যে যে সব ভুলে গিয়ে মনে রাখলে শুধু হাতের দাগ আর পাঁচশত টাকার চাকরি, তার চেয়ে অধম, ক্ষুদ্র ব্যক্তি আর ত আমি দেখতে পাইনে। তুমি বলছিলে এ আমার মোহ। ভাল, তাই যদি হয়, তুমি আশীর্ব্বাদ কর, এ মোহ আমার চিরদিনের মত কেটে যাক, আমি সমস্ত দেহ-মন দিয়ে তোমার দেশের কাজে লেগে যাই।

 ডাক্তারের ওষ্ঠাধর চাপা হাসিতে বিকশিত হইয়া উঠিল, কহিলেন, তোমার মুখের ভাবটা যে মোহ কাটার মতই তাতে আমার সন্দেহ নেই, কিন্তু মুস্কিল এই যে, কণ্ঠস্বরে তার আভাসটুকু পর্য্যন্ত নেই। তা সে যাই হোক, ভারতী, তোমাকে দিয়ে আমার দেশের কাজ কিন্তু এক তিলও হবে না। তার চেয়ে তোমার অপূর্ব্ববাবুই ঢের ভাল। দেনা-পাওনার চুল-চেরা বিচার করতে করতে বোঝা-পড়া একদিন তোমাদের হয়ে যেতেও পারে। বরঞ্চ, তাই করগে।

 ভারতী কহিল, তার মানে দেশকে আমি ভালবাসতে পারব না?

১৮৬