পাতা:পথের দাবী - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/১৯৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

চেয়ে রইল। আমি ত জানি তার বিহ্বল দৃষ্টি তখন কাকে খুঁজে বেড়াচ্ছিল। তাই তোমাকে আনতে পাঠিয়েছিলাম বোন। এখন যাই কেন না সে বলে থাক, ভারতী; এ ধাক্কা বোধ হয় আজও অপূর্ব্ব কাটিয়ে উঠতে পারেনি।

 ভারতী আর আপনাকে সংবরণ করিতে পারিল না, ঝর্ ঝর্ করিয়া কাঁদিয়া ফেলিয়া কহিল, কেন আমাকে তুমি এই সব শোনাচ্চ দাদা? তোমার চেয়ে কারও আশঙ্কা বেশি নয়, তাঁর আচরণে বেশি বিপদে তোমার চেয়ে কেউ পড়েনি; তবুও, কেবল আমার মুখ চেয়ে তাঁকে বাঁচাতে গিয়ে তুমি ঘরে-বাইরে শত্রু তৈরি করলে!

 ইস্? তাই বই কি?

 তবে কিসের জন্যে তাঁকে বাঁচাতে গেলে বল ত?

 বাঁচাতে গেলাম অপূর্ব্বকে? আরে ছি! আমি বাঁচাতে গেলাম ভগবানের এই অমূল্য সৃষ্টিটিকে। যে বস্তু তোমাদের মত এই দুটি সামান্য নরনারীকে উপলক্ষ্য করে গড়ে উঠেচে তার কি দাম আছে নাকি যে, ব্রজেন্দ্রের মত বর্ব্বরগুলোকে দেব তাই নষ্ট করে ফেলতে। শুধু এই ভারতী, শুধু এই! নইলে মানুষের প্রাণের মূল আছে না কি আমাদের কাছে। একটা কানাকড়িও না! এই বলিয়া ডাক্তার হাঃ হাঃ করিয়া হাসিতে লাগিলেন।

 ভারতী চোখ মুছিতে মুছিতে বলিল, কি হাসো দাদা, তোমার হাসি দেখলে আমার গা জ্বলে যায়। আমার এমন ইচ্ছে করে যে, তোমকে আঁচল চাপা দিয়ে কোন বনে-জঙ্গলে নিয়ে গিয়ে চিরকাল লুকিয়ে রেখে দি। যারা ধরে তোমাকে ফাঁসি দেবে তারাই কি তোমার দাম জানে? তারা কি টের পাবে জগতের কি সর্ব্বনাশ তারা করলে? নিজের দেশের লোকই তোমাকে খুনে, ডাকাত, রক্তপিপাসু—কত কথাই না বলে? কিন্তু আমি ভাবি, বুকের মধ্যে এত স্নেহ এত করুণা নিয়ে তুমি কেমন করে এর মধ্যে আছ!

 এবার ডাক্তার আর একদিকে চাহিয়া রহিলেন, সহসা জবাব দিতে পারিলেন না। তারপর মুখ ফিরাইয়া হাসিবার চেষ্টা করিলেন, কিন্তু এখন সেই স্বচ্ছন্দ সুন্দর হাসিটি মুখে ফুটিল না। কথা কহিলেন, কিন্তু সেই সহজ কণ্ঠস্বরে কোথা হইতে একটা অপরিচিত ভার চাপিয়া আসিল, কহিলেন, নিষ্ঠুরতা দিয়ে কি কখনো—আচ্ছা থাক্‌ সে কথা। তোমাকে একটা গল্প বলি। নীলকান্ত যোশী বলে একটি মারহাট্টা ছেলেকে তুমি দেখোনি, কিন্তু তোমাকে দেখে পর্য্যন্ত কেবলি আমার তাকেই মনে পড়ে। রাস্তা দিয়ে মড়া নিয়ে যেতে দেখলে তার চোখ দিয়ে জল পড়তো। একদিন রাত্রে কলম্বোর একটা পার্কের মধ্যে আমরা দুজনে বেড়া ডিঙিয়ে

১৮৯