পাতা:পথের দাবী - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/২০৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

২৩

 হাত-মুখ ধুইয়া আসিয়া ডাক্তার তাঁহার বোঁচকার উপরে চাপিয়া বসিলেন। পূর্ব্বোক্ত ছেলেটি মস্ত মোটা একটা বর্ম্মী সিগার টানিতে টানিতে ঘরে ঢুকিল এবং কয়েক মুহূর্ত্ত ধরিয়া নাক-মুখ দিয়া অপর্য্যাপ্ত ধূম উদ্গীরণ করিয়া চুরুটটি ডাক্তারের হাতে দিয়া প্রস্থান করিল। ভারতীর মুখে বিস্ময়ের চিহ্ন অনুভব করিয়া ডাক্তার সহাস্যে কহিলেন, অমনি পেলে আমি সংসারে কিছুই বাদ দিতে ভালবাসিনে ভারতী। অপূর্ব্বর কাকাবাবু আমাকে যখন রেঙ্গুনের জেটিতে প্রথম গ্রেপ্তার করেন, তখন পকেট থেকে আমার গাঁজার কলকে বার হয়ে পড়েছিল। নইলে, বোধ হয় ছুটি পেতাম না। এই বলিয়া তিনি মৃদু মৃদু হাসিতে লাগিলেন।

 ভারতী এ ঘটনা শুনিয়াছিল, কহিল, সে আমি জানি এবং হাজার ছুটি পেলেও যে ওটা তুমি খাও না তা-ও জানি। কিন্তু এ বাড়িটি কার দাদা?

 আমার।

 আর এই বর্ম্মী মেয়েটি এবং শিশুগুলি।

 ডাক্তার হাসিয়া ফেলিয়া কহিলেন, না ওঁরা আমার একটি মুসলমান বন্ধুর সম্পত্তি। আমারি মত ফাঁসি-কাঠের আসামী, কিন্তু সে অন্য বাবদে। সম্প্রতি স্থানান্তরে গেছেন, পরিচয় ঘটবার সুযোগ হবে না।

 ভারতী কহিল, পরিচয়ের জন্য আমি ব্যাকুল নই; কিন্তু সর্ব্বদিক থেকে তুমি যে স্বর্গপুরীতে এসে আশ্রয় নিয়েচ, তার থেকে আমাকে বাসায় রেখে এসো দাদা, এখানে আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে।

 ডাক্তার হাসিমুখে জবাব দিলেন, এ স্বর্গপুরী যে তোমার সইবে না, সে তোমাকে আনবার পূর্ব্বেই আমি জানতাম। কিন্তু তোমাকে বলবার আমার যত কথা ছিল, সে তো এই স্বর্গপুরী ছাড়া প্রকাশ করবারও আর দ্বিতীয় স্থান নেই ভারতী। আজ তোমাকে একটুখানি কষ্ট পেতেই হবে।

 ভারতী জিজ্ঞাসা করিল, তুমি কি শীঘ্রই আর কোথাও যাবে?

 ডাক্তার কহিলেন, হ্যাঁ। উত্তর এবং পূর্ব্বের দেশগুলো আর একবার ঘুরে আসতে হবে। ফিরতে হয় ত বছর দুই লাগবে। কিন্তু আজ তুমি নানারকমে এত ব্যথা পেয়েচ বোন, যে সকল কথা বলতে আমার লজ্জা হয়। কিন্তু আজকের রাত্রির পরে আর যে সহজে তোমাকে দেখা দিতে পারবো সে ভরসাও করিনে।

২০২