পাতা:পথের দাবী - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/২১২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

এজাহার দিলে ডাকাত পড়েছিল। ইংরাজ রাজত্ব হলে কতদূর কি হ’ত বলা যায় না, কিন্তু সেলিবিসের আইন-কানুন বোধ হয় আলাদা, লোকগুলোর নিশানদিহি যখন হল না, তখন পুঁতে-টুঁতে ফেললে বোধ হয়।

 বিবরণ শুনিয়া ভয়ে ও বিস্ময়ে ক্ষণকাল ভারতীর বাকরোধ হইয়া রহিল, পরে শুষ্ক বিবর্ণ মুখে অস্ফুটকণ্ঠে কহিল, পুঁতে-টুতে ফেললে কি? তোমার হাতে কি তবে এতগুলো মানুষ মারা গেল নাকি?

 ডাক্তার কহিলেন, আমি উপলক্ষ্য মাত্র। নইলে নিজের হাতেই তারা মারা গেল ধরতে হবে।

 আর ভারতী কথা কহিল না, শুধু একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলিয়া চুপ করিয়া বসিয়া রহিল। ডাক্তার নিজেও কিছুক্ষণ স্থির থাকিয়া বলিলেন, তারপরে কতক নৌকায় কতক ঘোড়ার গাড়িতে কতক স্টিমারে মিনাডো শহরে এসে পৌঁছালাম এবং সেখানে থেকে নাম ধাম ভাঁড়িয়ে একটা চীনা জাহাজে চড়ে কোন মতে দু’জনে ক্যানটনে এসে উপস্থিত হলাম। কিন্তু আর বোধ হয় তোমার শুনতে ইচ্ছে করচে না? ঠিক না ভারতী? কেবলি মনে হচ্চে দাদার হাতেও মানুষের রক্ত মাখানো?

 অন্যমনস্ক ভারতী তাঁহার মুখের প্রতি চাহিয়া কহিল, আমাকে বাসায় পৌঁছে দেবে না দাদা?

 এখনি যাবে?

 হাঁ, আমাকে তুমি দিয়ে এসো!

 তবে চল। এই বলিয়া তিনি মেঝের একখানা তক্তা সরাইয়া কি একটা বস্তু লুকাইয়া পকেটে লইলেন। ভারতী বুঝিল তাহা গাদা পিস্তল। পিস্তল তাহারও আছে এবং সুমিত্রার উপদেশ মত সে-ও ইতিপূর্ব্বে গোপনে সঙ্গে লইয়া পথে বাহির হইয়াছে, কিন্তু ইহা যে মানুষ মারিবার যন্ত্র; এ চৈতন্য আজ যেন তাহার প্রথম হইল। আর ঐ যেটা ডাক্তারের পকেটে রইল, হয়ত কত নরহত্যাই উহা করিয়াছে এই কথা মনে করিয়া তাহার সর্ব্বাঙ্গে কাঁটা দিয়া উঠিল।

 নৌকায় উঠিয়া ভারতী ধীরে ধীরে বলিল, তুমি যাই কেননা কর, তুমি ছাড়া আমার আর পৃথিবীতে দ্বিতীয় আশ্রয় নেই। যতদিন না আমার মন ভাল হয় আমাকে তুমি ফেলে যেতে পারবে না দাদা। বল যাবে না?

 ডাক্তার মৃদু হাসিয়া কহিলেন, আচ্ছা, তাই হবে বোন, তোমার কাছে ছুটি নিয়েই আমি যাবো।

২০৮