পাতা:পথের দাবী - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/২২০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

 ভারতী হাসিতে লাগিল। শশী কহিতে লাগিল, ড্রাফটটা এলেই ব্যাঙ্কে জমা করে দেব। মাতাল, জোচ্চোর, স্পেণ্ডথ্রিফ্‌ট্ যা মুখে এসেচে লোকে বলেচে, কিন্তু এবার দেখবো। আসলে হাত পড়বে না, কেবল সুদের টাকাতে সংসার চালিয়ে দেবো, বরঞ্চ বাঁচবে দেখবেন, পোস্ট অফিসেও একটা একাউণ্ট খুলতে হবে,—ধরে কিন্তু রাখা চলবে না। চাই কি বছর পাঁচেকের মধ্যে একটা বাড়ি কিনতেও পারবো। আর কিনতেই ত হবে,— সংসার ঘাড়ে পড়ল কিনা। সহজ নয়ত আজকালকার বাজারে।

 ভারতীর মুখের দিকে চাহিয়া ডাক্তার হাঃ হাঃ করিয়া হাসিয়া উঠিলেন, কিন্তু সে মুখ গম্ভীর করিয়া আর একদিকে চাহিয়া রহিল।

 শশী কহিল, মদ ছেড়ে দিয়েচি শুনেচেন বোধ হয়?

 ডাক্তার কহিলেন, না।

 শশী কহিল, হাঁ একেবারে। নবতারা প্রতিজ্ঞে করিয়ে নিয়েছেন।

 এই লইয়া উহাদের আলোচনা দীর্ঘ হইতে পারিত, কিন্তু একজনের সকৌতুক প্রশ্নমালায় ও অপরের উৎসাহদীপ্ত উত্তর দানের ঘটায় ভারতী বিপন্ন হইয়া উঠিল। সে কোনটাতেই যোগ দিতে পারিতেছে না দেখিয়া ডাক্তার অন্য প্রসঙ্গের অবতারণা করিয়া আসল কথা পাড়িলেন। কহিলেন, শশী, তুমি ত তাহলে এখান থেকে আর শীঘ্র নড়তে পারচ না।

 শশী বলিল, নড়া? অসম্ভব।

 ডাক্তার কহিলেন, বেশ, আমাদের তাহলে এখানে একটা স্থায়ী আড্ডা রইল।

 শশী তৎক্ষণাৎ জবাব দিল, সে কি করে হতে পারে? আপনার সঙ্গে ত আর আমি সম্বন্ধ রাখতে পারব না। লাইফ আমার রিস্ক করা যায় না।

 ডাক্তার ভারতীকে লক্ষ্য করিয়া হাসিমুখে বলিলেন, আমাদের ওস্তাদের আর যা দোষই থাক্, চক্ষুলজ্জা আছে এ অপবাদ অতি বড় শত্রুতেও দেবে না। পার যদি এই বিদ্যেটা ওর কাছে শিখে নাও ভারতী।

 প্রত্যুত্তরে শশীর পক্ষ লইয়া ভারতী অত্যন্ত ভালমানুষের মত বলিল, কিন্তু মিথ্যে আশা দেওয়ার চাইতে স্পষ্ট বলাই ত ভাল। আমি পারিনে, কিন্তু অতুলবাবুর কাছে এ বিদ্যে শিখে নিতে পারলে আজ ত আমার ছুটি হয়ে যেতো দাদা।

 তাহার কণ্ঠস্বরের শেষ দিকটা হঠাৎ যেন কেমন ভারি হইয়া গেল। শশী মনোনিবেশ করিল না, করিলেও হয়ত তাৎপর্য্য বোধ করিত না, কিন্তু ইহার নিহিত অর্থ যাঁহার বুঝিবার তাঁহার বিলম্ব হইল না।

 মিনিট-দুই সকলে মৌন হইয়া রহিলেন। প্রথম কথা কহিলেন ডাক্তার,

২১৬