পাতা:পথের দাবী - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/২২২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

শুধু কি এই অমূল্য প্রাণটার দাম বোঝবার বৃদ্ধিটুকুই দিতে ভুলেছিলেন! সেই জাপানীদের দেশেই তুমি আবার যেতে চাও?

 শশী কহিল, আমিও ঠিক সেই কথাই বলি ভারতী। বলি, অতবড় স্বার্থপর, লোভী, নীচাশয় জাতির কাছে কোন প্রত্যাশাই করবেন না। তারা কোন দিন আপনাকে কোন সাহায্যই করবে না।

 ডাক্তার হাসিয়া কহিলেন, কোমরে সেই দড়ি বাঁধার ঘটনাও শশী ভুললে না, জাপানীদের সে এ জীবনে মাপ করতেও পারলে না। কিন্তু এই তাদের সমস্তটুকু নয় ভারতী, এতবড় আশ্চর্য্য জাতও পৃথিবীতে আর নেই। শুধু আজকের কথা নয়, প্রথম দৃষ্টিতেই তারা সাদা চামড়াকে চিনেছিল। অড়াইশ বৎসর আগে যে জাত আইন করতে পেরেছিল, চন্দ্র সূর্য্য যতদিন বিদ্যমান থাকবে খ্রীষ্টান যেন না তাদের রাজ্যে ঢোকে এবং সে যেন তার চরম শাস্তি ভোগ করে, সে-জাত যাই কেননা করে থাক তারা আমার নমস্য!

 বক্তার দুইচক্ষু এক নিমিষেই প্রদীপ্ত অগ্নিশিখার ন্যায় জ্বলিয়া উঠিল। সেই বজ্রগর্ভ ভয়ঙ্কর দৃষ্টির সম্মুখে শশী যেন উদ্‌ভ্রান্ত হইয়া গেল, সে সভয়ে বারবার মাথা নাড়িয়া বলিতে লাগিল, সে ঠিক! সে ঠিক!

 ভারতীয় মুখ দিয়া কথা বাহির হইল না, তাহার বুকের মধ্যেটা যেন অভূতপূর্ব্ব অব্যক্ত আবেগে ধথর থর করিয়া কাঁপিয়া উঠিল। তাহার মনে হইল আজ এই গভীর নিশীথে, আসন্ন বিদায়ের প্রাক্কালে এক মুহূর্ত্তের জন্য এই লোকটির সে স্বরূপ দেখিতে পাইল।

 ডাক্তার নিজের বক্ষদেশে আঙ্গুলি নির্দ্দেশ করিয়া কহিলেন, কি বলছিলে ভারতী, এর মূল্য বোঝাবার মত বুদ্ধি ভগবান আমাকে দেননি। মিছে কথা! শুনবে আমার সমস্ত ইতিহাস? ক্যানটনের একটা গুপ্তসভার মধ্যে সুনিয়াৎ সেন আমাকে একবার বলেছিলেন—

 ভারতী হঠাৎ ভয় পাইয়া বলিয়া উঠিল, কারা যেন সিঁড়ি দিয়ে উঠচে—

 ডাক্তার কান খাড়া করিয়া শুনিলেন, পকেট হইতে ধীরে-সুস্থে পিস্তল বাহির করিয়া কহিলেন, এই অন্ধকারে আমাকে বাঁধতে পারে পৃথিবীতে কেউ নেই। এই বলিয়া তিনি উঠিয়া দাঁড়াইলেন, কিন্তু তাঁহার মুখে উদ্বেগের ছায়া পড়িল।

 কেবল বিচলিত হইল না শশী। সে মুখ তুলিয়া কহিল, আজ নবতারাদের একবার আসার কথা ছিল, বোধ হয়—

 ডাক্তার হাসিয়া ফেলিয়া কহিলেন, বোধ হয় নয়, তিনিই। অত্যন্ত লঘু পদ! কিন্তু সঙ্গে তাঁর ‘দের’টা আবার কারা?

২১৮