পাতা:পথের দাবী - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/২২৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

ব্রজেন্দ্র, তোমার আপনারই সবুর সইল না। পরের প্রাণ নিতে ত তুমি সদাই প্রস্তুত, কিন্তু নিজের বেলা কিরকম মনে হয়?

 ব্রজেন্দ্রের বুখ কালো হইয়া উঠিল। মুহূর্ত্তকাল সে নিজেকে সংবরণ করিয়া লইয়া দম্ভভরে কহিয়া উঠিল, আমি এনার্কিস্ট, আমি রেভোলিউশনারি, প্রাণ আমার কাছে কিছুই নয়,—দিতেও পারি, নিতেও পারি।

 ডাক্তার শান্তকণ্ঠে বলিলেন, তাহলে আজ রাত্রে সেটা দিতে হবে,—কিন্তু বেল্ট থেকে ওটা টেনে বার করবার সময় হবে না ব্রজেন্দ্র, আমার চোখ আছে,তোমাকে আমি চিনি। এই বলিয়া তিনি পিস্তল সমেত বাঁ হাত তুলিয়া ধরিলেন; ভারতী ব্যাকুল হইয়া সে হাত তাঁহার চাপিয়া ধরিবার চেষ্টা করিতেই তিনি ডান হাত দিয়া তাহাকে সরাইয়া দিয়া শুধু বলিলেন, ছিঃ।

 ঘরের মধ্যে চক্ষের নিমিষে যেন একটা বজ্রপাত ঘটিয়া গেল।

 সুমিত্রার ঠোঁট কাঁপিতে লাগিল, বলিল, নিজেদের মধ্যে এ সব কি বলুন ত?

 তলওয়ারকর এতক্ষণ পর্য্যন্ত একটা কথাও কহে নাই, এখন সে আস্তে আস্তে জিজ্ঞাসা করিল, আপনার দলের সকল নিয়ম আমি জানিনে। আপনার সঙ্গে মতভেদের শাস্তি কি এখানে মৃত্যু? অপূর্ব্ববাবু বেঁচে গেছেন এতে আমি মনে মনে খুশীই হয়েছি, কিন্তু আপনার অন্যায় তাতে কম হয়নি, এ সত্য বলতে আমি বাধ্য।

 কৃষ্ণ আইয়ার ঘাড় নাড়িয়া ইহাতে সায় দিল! ব্রজেন্দ্রর কণ্ঠস্বরে আর উপহাসের স্পর্দ্ধা ছিল না, কিন্তু সে অনেকের সহানুভূতিতে বল পাইয়া বলিল, একজনের প্রাণ যাওয়া যখন চাই, তখন আমারই না হয় থাক। আমি প্রস্তুত।

 সুমিত্রা বলিল, ট্রেটরের বদলে যদি একজন ট্রায়েড কমরেডের রক্তই তোমার প্রয়োজন, তখন আমিও ত দিতে পারি ডাক্তার।

 ডাক্তার স্থির হইয়া বসিয়া রহিলেন, এই উচ্ছ্বাসের সহসা কোন জবাব দিবার চেষ্টা করিলেন না। মিনিট-দুই পরে নিজের মনেই একটুখানি মুচকিয়া হাসিয়া কহিলেন, সে সব বহুকালের কথা, তখন কোথায়ই বা তোমরা? এই ট্রায়েড কমরেডটিকে তখন থেকেই আমি জানি—সে থাক। টোকিওর একটা হোটেলে বসে সুনিয়াৎ সেন একদিন বলেছিলেন নৈরাশ্য সহ্য করার শক্তি যার যত কম সে যেন এ রাস্তা থেকে ততদিন দূরে দূরেই চলে। অতএব, এ আমার সইবে। কিন্তু ব্রজেন্দ্র, তোমাকে আমি মিথ্যে ভয় দেখাবার চেষ্টা করিনি। আমাকে অন্যত্র যেতে হচ্চে, কিন্তু ডিসিপ্লিন ভেঙে গেলে ত আমার চলবে না। সুমিত্রাকে যদি তোমার দলেই পাও, আই উইশ ইউ গুড লাক্‌। কিন্তু আমার পক্ষ তুমি ছাড়। সুরাভারায়

২২২