পাতা:পথের দাবী - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/২২৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

 শশী চুপ করিয়া রহিল। ডাক্তার সকৌতুক স্নিগ্ধস্বরে কহিলেন, মনে থাকবে হে শশী, থাকবে। এ বস্তু জগতে এত সুন্দর নয় যে কেউ সহজে ভোলে।

 শশী কহিল, আপনি কবে যাবেন? তার আগে কি আর দেখা হবে না?

 ডাক্তার বলিলেন, ধরে রাখো দেখা হবেই না। কিন্তু তুমি ত আমার বয়সে ছোট, আমি আশীর্ব্বাদ করে যাচ্চি তুমি যেন সুখী হতে পারো।

 শশী সবিনয়ে কহিল, আসচে শনিবারটা পর্য্যন্ত কি থাকতে পারেন না?

 ভারতী কহিল, শনিবারে যে ওঁদের বিয়ে।

 ডাক্তার মুখ টিপিয়া হাসিলেন, কিন্তু কিছুই বলিলেন না। সম্মুখে নদী, কাঠের মাড়ের পাশে ক্ষুদ্র তরণী শেষ ভাঁটায় কাদার উপরে কাত হইয়া পড়িয়াছে। সোজা করিয়া ভারতীকে সযত্নে তুলিয়া দিয়া তিনি নিজেও উঠিয়া বসিলেন। শশী বলিল, শনিবারটা আপনাকে থেকে যেতে হবে। জীবনে অনেক ভিক্ষে দিয়েছেন, এটিও আমাকে দিন। ভারতী, আপনাকেও সেদিন আসতে হয়।

 ভারতী মৌন হইয়া রহিল। ডাক্তার বলিলেন, ও আসবে না শশী, কিন্তু আমি যদি থেকে যেতে পারি অন্ধকারে গা ঢেকে এসে তোমাদের একবার আশীর্ব্বাদ করে যাবো, আমি কথা দিয়ে যাচ্চি। আর যদি না আসি, নিশ্চয় জেনো সব্যসাচীর পক্ষেও তা সম্ভব ছিল না। কিন্তু যেখানেই থাকি, সেদিন তোমার জন্য এই প্রার্থনাই করব, বাকি দিনগুলো যেন তোমার সুখে কাটে। এই বলিয়া তিনি হাতের লগি দিয়া কাঠের স্তূপে সজোরে ঠেলা দিতেই ছোট নৌকা কাদার উপর দিয়া পিছলাইয়া নদীর জলে গিয়া পড়িল।

 জোয়ার তখন আরম্ভ হয় নাই, কিন্তু ভাঁটার টানে ঢিলা পড়িয়া আসিয়াছে। সেই মন্দীভূত স্রোতে উচ্চ তীরভূমির অন্ধকার ছায়ার নীচে দিয়া তাহার ক্ষুদ্র তরণী ধীরে ধীরে পিছাইয়া চলিতে লাগিল। ও-পারের জন্য পাড়ি দিতে তখনও বিলম্ব ছিল, ডাক্তার হাতের দাঁড় যথাস্থানে রাখিয়া দিয়া স্থির হইয়া বসিলেন।

 শ্রান্ত ভারতী তাঁহার ক্রোড়ের উপর কনুই রাখিয়া হেলান দিয়া বসিয়া বলিল, আজ একলা থাকলে আমি এমন কান্না কাঁদতাম যে নদীর জল বেড়ে যেতো। ভবিষ্যতে সকলেরই সুখী হবার অধিকার আছে, নেই কি কেবল তোমার? শশীবাবু অতবড় বিশ্রী কাজ করতে উদ্যত, তাকেও তুমি মন খুলে আশীর্ব্বাদ করে এলে, শুধু কেউ নেই পৃথিবীতে সুখী হও বলে তোমাকে আশীর্ব্বাদ করবার? তুমি গুরুজন হও আর যাই হও, তোমাকেও আজ আমি ঠিক ওই বলে আশীর্ব্বাদ করব, যেন তুমিও ভবিষ্যতে সুখী হতে পারো।

 ডাক্তার সহাস্যে কহিলেন, ছোটর আশীর্ব্বাদ খাটে না। উল্টো ফল হয়।

২২৪