পাতা:পথের দাবী - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/২৩০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

হাতে সুমিত্রাকে ফেলে রেখে যেতে চাচ্চো? এত বড় নিষ্ঠুর তুমি হতে পারে। আমি ভাবতেই পারিনে।

 ডাক্তার কহিলেন, তাই ত আজ যাবার আগে সমস্ত চুকিয়ে দিয়ে যেতে চেয়েছিলাম,— কিন্তু সুমিত্রাই ত হতে দিলে না।

 ভারতী সভয়ে প্রশ্ন করিল, হতে দিলে না কি রকম? তুমি কি সত্যিই ব্রজেন্দ্রকে মেরে ফেলতে চেয়েছিলে নাকি?

 ডাক্তার ঘাড় নাড়িয়া বলিলেন, হ্যাঁ, সত্যিই চেয়েছিলুম। ইতিমধ্যে পুলিশের লোকে যদি না তাকে জেলে পাঠায় ত ফিরে এসে একদিন আমাকেই এ কাজ সম্পন্ন করতে হবে।

 এতক্ষণ পর্য্যন্ত ভারতী তাঁহার ক্রোড়ের উপর হেলান দিয়া বসিয়া ছিল, এই কথার পর উঠিয়া বসিয়া একেবারে স্তব্ধ হইয়া রইল। সে যে অন্তরের মধ্যে একটা কঠিন আঘাত পাইল ডাক্তার তাহা বুঝিলেন, কিন্তু কোন কথা না কহিয়া পরপারের জন প্রস্তুত হইয়া পার্শ্বে রক্ষিত দাঁড় দুটা দুই হাতে টানিয়া লইলেন।

 অনেকক্ষণ পরে ভারতী আস্তে আস্তে জিজ্ঞাসা করিল, আচ্ছা দাদা, আমি যদি তোমার সুমিত্রা হোতাম এমনি করে কি আমাকে ফেলে যেতে পারতে?

 ডাক্তার হাসিলেন, বলিলেন; কিন্তু তুমি ত সুমিত্রা নও; তুমি ভারতী। তাই তোমাকে আমি ফেলে যাবো না, কাজের জন্য রেখে যাবো।

 ভারতী ব্যগ্র হইয়া কহিল, রক্ষে কর দাদা, তোমাদের এই সব খুনোখুনি রক্তারক্তির মধ্যে আমি আর নেই। তোমার গুপ্ত-সমিতির কাজ আমাকে দিয়ে আর হবে না।

 ডাক্তার বলিলেন, তার মানে এঁদের মত তুমিও আমাকে ত্যাগ করে যেতে চাচ্চো?

 এই উক্তি শুনিয়া ভারতী ক্ষোভে ব্যাকুল হইয়া উঠিল, কহিল, এত বড় অন্যায় কথা তুমি আমাকে বলতে পারো দাদা? তুমি যা ইচ্ছে করতে পারো, কিন্তু আমি নিজে থেকে তোমাকে ত্যাগ করে গেছি, এ কথা মনে হলে কি একটা দিনের জন্যেও বাঁচতে পারি তুমি ভাবো? আমি তোমারই কাজ করে যাবো, যত দিন না তুমি স্বেচ্ছায় আমাকে ছুটি দাও। একটুখানি থামিয়া কহিল, কিন্তু আমি ত জানি, মানুষ খুন করে বেড়ানোই তোমার আসল কাজ নয়, তোমার কাজ মানুষকে মানুষের মত করে বাঁচানো। তোমার সেই কাজে আমি লেগে থাকবো এবং সেই ভেবেই ত তোমাদের মধ্যে আমি এসেছিলাম।

 ডাক্তার এক মুহূর্ত্তের জন্য দাঁড়টানা বন্ধ রাখিয়া প্রশ্ন করিলেন, সে কাজটা আমার কি?

২২৬