পাতা:পথের দাবী - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/২৩২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

মাসের বিপ্লব ফরাসীদের ইতিহাসে আজও অক্ষয় হয়ে আছে। কুলি-মজুরদের রক্তে সেদিন সহরের সমস্ত রাজপথ একেবারে রাঙা হয়ে উঠেছিল। এই ত সেদিনের জাপান—সেদেশেও দিনমজুরের দুঃখের ইতিহাস একহিন্দু বিভিন্ন নয়। মানুষের চলবার পথ মানুষ কোন দিন নিরুপদ্রবে ছেড়ে দেয় না ভারতী।

 ভারতী শিহরিয়া উঠিয়া বলিল, সে আমি জানিনে, কিন্তু ওই সব ভয়ানক উৎপাত কি তুমি এদেশেও টেনে আনবে নাকি? যাদের একফোঁটা ভাল করবার জন্যে আমরা অহর্নিশি পরিশ্রম করেছি, তাদেরই রক্ত দিয়ে কারখানার রাস্তায় নদী বহাতে চাও না কি?

 ডাক্তার অবলীলাক্রমে কহিলেন, নিশ্চয় চাই? মহামানবের মুক্তি সাগরে মানবের রক্তধারা তরঙ্গ তুলে ছুটে যাবে সেই ত আমার স্বপ্ন। এতকালের পর্ব্বতপ্রমাণ পাপ তবে ধুয়ে যাবে কিসে? আর সেই ধোয়ার কাজে তোমার দাদার দু’ ফোঁটা রক্তের যদি প্রয়োজন হয় ত আপত্তি করব না ভারতী।

 ভারতী কহিল, ততটুকু তোমাকে চিনি দাদা। কিন্তু দেশের মধ্যে এই অশান্তি ঘটিয়ে তোলবার জন্যেই এতবড় ফাঁদ পেতে বসে আছো? এর চেয়ে বড় আদর্শ তোমার নেই।

 ডাক্তার বলিলেন, আজও ত খুঁজে পাইনি বোন। অনেক ঘুরেচি, অনেক পড়েছি, অনেক ভেবেচি। কিন্তু তোমাকে ত আমি আগেও বলেছি, ভারতী, অশান্তি ঘটিয়ে তোলা মানেই অকল্যাণ ঘটিয়ে তোলা নয়। শান্তি! শান্তি! শান্তি! শুনে শুনে কান একেবারে ঝালাপালা হয়ে গেছে। কিন্তু এ অসত্য এতদিন ধরে কারা প্রচার করেচে জানো? পরের শান্তি হরণ করে যারা পরের রাস্তা জুড়ে অট্টালিকা প্রাসাদ বানিয়ে বসে আছে তারাই এই মিথ্যামন্ত্রের ঋষি। বঞ্চিত, পীড়িত, উপদ্রুত নরনারীর কানে অবিশ্রান্ত এই মন্ত্র জপ করে তাদের এমন করে তুলেচে যে, আজ তারাই অশান্তির নামে চমকে উঠে ভাবে এ বুঝি পাপ, এ বুঝি অমঙ্গল! বাঁধা গরু অনাহারে দাঁড়িয়ে মরতে দেখেচ? সে দাঁড়িয়ে মরে তবু সেই জীর্ণ দড়িটা ছিঁড়ে ফেলে মনিবের শান্তি নষ্ট করে না। তাই ত হয়েচে, তাই ত আজ দীন-দরিদ্রের চলার পথ একেবারে রুদ্ধ হয়ে গেছে। তবুও তাদের অট্টালিকা প্রাসাদ চুর্ণ করার কাজে তাদেরি সাথে কণ্ঠ মিলিয়ে যদি আমরাও আজ অশান্তি বলে কাঁদতে থাকি ত পথ পাবো কোথায়? না ভারতী, সে হবে না। ও প্রতিষ্ঠান যত প্রাচীন যত পবিত্র, যত সনাতনই হোক, মানুষের চেয়ে বড় নয়,—আজ সে-সব আমাদের ভেঙে ফেলতে হবে। ধুলো ও উড়বেই, বালি ও ঝরবেই, ইঁট পাথর ধসে মানুষের মাথায় পড়বেই ভারতী, এই ত স্বাভাবিক।

২২৮