পাতা:পথের দাবী - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/২৩৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

 ভারতী বলিল, তাও যদি হয় দাদা, শান্তির পথ ছেড়ে দিয়ে আগে থেকেই অশান্তির পথে পা বাড়াবো কেন?

 ডাক্তার বলিলেন, তার কারণ, শান্তির পথ ঐ সনাতন, পবিত্র ও সুপ্রাচীন সভ্যতার সংস্কার দিয়ে এঁটে বন্ধ করা আছে বলে। কেবল ঐ বিপ্লবের পথটাই আজও খোলা আছে।

 ভারতী প্রশ্ন করিল, আমরা যেদিন কারখানার কারিকরদের সঙ্ঘবদ্ধ করে নিরুপদ্রব ধর্ম্মঘট করবার আয়োজন করেছিলাম সেও কি তবে তাদের মঙ্গলের জন্যে নয়? তুমি চলে গেলে পথের দাবীর সে প্রচেষ্টাও কি আমাদের বন্ধ করে দিতে হবে?

 ডাক্তার বলিলেন, না। কিন্তু সে কর্ত্তব্য তোমার নয়, সুমিত্রার। তোমার কাজ আলাদা। ভারতী, ধর্ম্মঘট বলে একটা বস্তু আছে, কিন্তু নিরুপদ্রব-ধর্ম্মঘট বলে কোথাও কিছু নেই। সংসারে কোন ধর্ম্মঘটই কখনো সফল হয় না, যতক্ষণ না পিছনে তার বাহবল থাকে। শেষ পরীক্ষা তাকেই দিতে হয়।

 ভারতী বিস্ময়ে প্রশ্ন করিল, কাকে দিতে হবে? শ্রমিককে?

 ডাক্তার বলিলেন, হাঁ। তুমি জানো না, কিন্তু সুমিত্রা ভাল করেই জানে যে ধনীর আর্থিক ক্ষতি এবং দরিদ্রের অনশন একবস্তু নয়। তার উপায়হীন, কর্ম্মহীন দিনগুলো দিনের পর দিন তাকে উপবাসের মধ্যে ঠেলে নিয়ে যায়। তার স্ত্রী পুত্র পরিবার ক্ষুধায় কাঁদতে থাকে,—তাদের অবিশ্রান্ত ক্রন্দন অবশেষে একদিন তাকে পাগল করে তোলে,— তখন পরের অন্ন কেড়ে খাওয়া ছাড়া জীবনধারণের আর সে পথ খুঁজে পায় না। ধনী সেই শুভদিনের প্রতীক্ষা করেই স্থির হয়ে থাকে। অর্থ-বল, সৈন্যবল, অস্ত্র-বল সবই তার হাতে,—সে-ই ত রাজশক্তি। সেদিন সে আর অবহেলা করে না—তোমার ঐ সনাতন শান্তি ও পবিত্র শৃঙ্খলার জয়জয়কার হোক, সেদিন নিরস্ত্র নিরন্ন দরিদ্রের রক্তে নদী বহে যায়।

 ভারতী রুদ্ধশ্বাসে কহিল, তার পরে?

 ডাক্তার বলিলেন, তার পরে আবার একদিন সেসব পীড়িত, পরাভূত ক্ষুধাতুর শ্রমিকের দল এসে সেই হত্যাকারীর দ্বারেই হাত পেতে দাঁড়ায়। ভিক্ষা পায়।

 ভারতী কহিল, তার পরে?

 ডাক্তার বলিলেন, তারও পরে? তারপরে আবার একদিন সে দলবদ্ধ হয়ে পূর্ব্ব অত্যাচারের প্রতিকারের আশার ধর্ম্মঘট করে বসে, তখন আবার সেই পুরাতন কাহিনীর পুনরাভিনয় হয়।

২২৯