পাতা:পথের দাবী - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/২৩৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

 ভারতীর মন মুহূর্ত্তকালের জন্য একেবারে নিরাশায় ভরিয়া গেল, ধীরে ধীরে কহিল, তবে ধর্ম্মঘটে লাভ কি দাদা?

 ডাক্তারের চোখের দৃষ্টি অন্ধকারেও জ্বলিয়া উঠিল, কহিলেন, লাভ? এই ত পরম লাভ ভারতী। ওই ত আমার বিপ্লবের রাজপথ। রত্নহীন, অন্নহীন, জ্ঞানহীন দরিদ্রের পরাজয়টাই সত্য হল, আর তার বুক জুড়ে যে বিষ উপচে উছলে ওঠে, জগতে সে শক্তি সত্য নয়? সেই ত আমার মূলধন। কোথাও কোন দেশে নিছক বিপ্লবের জন্যই বিপ্লব বাধানো যায় না, ভারতী, একটা কিছু অবলম্বন তার চাই-চাই, সেই ত আমার অবলম্বন। যে মূর্খ একথা জানে না, শুধু মজুরির কম বেশি নিয়ে ধর্ম্মঘট বাধাতে চায়, সে তাদেরও সর্ব্বনাশ করে, দেশেরও করে।

 ভারতী সহসা কহিল, নৌকা বোধ হয় আমাদের অনেকখানি পেছিয়ে এসেছে দাদা।

 ডাক্তার হাসিলেন, বলিলেন, সে দিকেও চোখ আছে দিদি, কোথায় যেতে হবে তা ভুলিনি।

 ভারতী কহিল, কেন যে এর মধ্যে থেকে আমাকে তুমি বিদায় দিতে চাও এতক্ষণে তা বুঝেছি; আমি ভারী দুর্ব্বল। হয়ত তারই মতই দুর্ব্বল। আমি কিছু নয়,—আজও তোমার সমস্ত ভরসা সেই সুমিত্রাদিদির ’পরেই। কিন্তু এ কথা আমি কিছুতে মানবো না যে, এ ছাড়া আর পথ নেই, মানুষের সমস্ত খোঁজাই একেবারে নিঃশেষ হয়ে গেছে। একজনের মঙ্গলের জন্য আর একজনের অমঙ্গল করতেই হবে, এ আমি কোনমতেই চরম সত্য বলে নেব না,—তুমি বললেও না।

 সে আমি জানি বোন।

 ভারতী কহিল, কিন্তু তোমার কাজ ছেড়েই বা আমি যাই কি করে? থাকবো কি নিয়ে? ফিরে যদি আর না এসো আমি বাঁচবো কি করে?

 সেও আমি জানি।

 ভারতী বলিল, জান তুমি সব। তবে?

 কিছুক্ষণ নিঃশব্দে কাঢিল। উত্তর না পাইয়া ভারতী ধীরে ধীরে বলিল, বিপ্লব যে কি, কেন এর এত প্রয়োজন মনের মধ্যে আমি ধারণাই করতে পারিনি। তবু তোমার মুখ থেকে যখন শুনি বুকের ভেতরটায় কেমন যেন কাঁদতে থাকে। মনে হয় মানুষের দুঃখের ইতিহাস তুমি কতই না চোখে দেখেচ। নইলে এমন করে তোমাকে পাগল করেচে কিসে? আচ্ছা, যাবার সময় কি আমাকে তুমি সঙ্গে নিজে পারো না দাদা?

 ডাক্তার হাসিয়া বলিলেন, তুমি ক্ষেপেচ ভারতী?

২৩০