পাতা:পথের দাবী - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/২৪১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

নন এ-কথা আমি কিছুতেই মেনে নিতে পারব না। আমি সকলের কথাই বলচিনে, কিন্তু সত্য সত্যই যাঁরা রাষ্ট্রনীতিবিদ্—যথার্থই যাঁরা দেশের শুভাকাঙ্খী, তাঁদের সকল শ্রমই ব্যর্থ শ্রম এ-কথা নিঃসঙ্কোচে স্বীকার করা কঠিন; মত এবং পথ বিভিন্ন বলেই কাউকে ব্যঙ্গ করা সাজে না।

 তাহার কণ্ঠস্বরে গাম্ভীর্য্য উপলব্ধি করিয়া ডাক্তার চুপ করিলেন। পিছন হইতে একটা ষ্টিম লঞ্চ যথেষ্ট সাড়া-শব্দ করিয়া তাঁদের ক্ষুদ্র তরণীকে রীতিমত দোল দিয়া বাহির হইয়া গেলে সব্যসাচী ধীরে ধীরে বলিলেন, ভারতী, তোমাকে ব্যথা দেওয়া আমার উদ্দেশ্য নয়, তোমার নমস্যগণকে উপহাস করাও আমার অভিপ্রায় নয়! তাঁদের রাজনীতিবিদ্যার পাণ্ডিত্য সম্বন্ধেও আমার ভক্তিও কম নেই, কিন্তু কি জানো দিদি, গৃহস্থ গরুকে যখন খাটো করে বাঁধে, তখন তার সেই ছোট্ট দড়িটুকুর মধ্যে নীতি একটিমাত্রই থাকে। আমি সেইটুকু মাত্রই জানি। গরুর একান্ত নাগালের বাইরে খাদ্যবস্তুর প্রতি প্রাণপণে গলা এবং জিভ বাড়িয়ে লেহন করার চেষ্টার মধ্যে অবৈধতা কিছুমাত্র নেই, এমন কি অত্যন্ত আইনসঙ্গত। উৎসাহ দেবার মত হৃদয় থাকলে দিতেও পারো, রাজার নিষেধ নেই, কিন্তু বৃষের এই আন্তরিক প্রবল উদ্যম বাইরে থেকে যারা দেখে, তাদের পক্ষে হাস্য সম্বরণ করা কঠিন।

 ভারতী হাসিয়া ফেলিয়া বলিল, দাদা, তুমি ভারি দুষ্টু। বলিয়াই আপনাকে সংযত করিয়া কহিল, কিন্তু এ আমি ভেবে পাইনে, প্রাণ যার অহর্নিশি সরু সুতোর ঝুলছে সে, কি করে হাসি-তামাসা করে পরের কথা নিয়ে!

 ডাক্তার সহজকণ্ঠে বলিলেন, তার কারণ, এ সমস্যার মীমাংসা পূর্ব্বেই হয়ে গেছে ভারতী, যেদিন বিপ্লবের কাজে যোগ দিয়েছি। আর আমার ভাববারও নেই, নালিশ করবারও নেই। আমি জানি আমাকে হাতে পেয়েও যে রাজশক্তি ছেড়ে দেয়, হয় সে অক্ষম উন্মাদ, নয় তার ফাঁস দেবার দড়িটুকু পর্য্যন্ত নেই!

 ভারতী বলিল, তাই ত আমি তোমার সঙ্গে থাকতে চাই দাদা। আমি উপস্থিত থাকতে তোমার প্রাণ নিতে পারে সংসারে এমন কেউ নেই। এ আমি কোনমতেই হতে দেব না। বলিতে বলিতেই গলা তাহার চক্ষের পলকে ভারি হইয় আসিল।

 ডাক্তার টের পাইলেন। নিঃশব্দে নিশ্বাস ফেলিয়া বলিলেন, নৌকায় জোয়ার লেগেচে, ভারতী, পৌঁছতে আর আমাদের দেরি হবে না।

 প্রত্যুত্তরে ভারতী শুধু কহিল, মরুকগে। কিছুই আমার ভাল লাগছে না। মিনিট দুই পরে জিজ্ঞাসা করিল, এতবড় রাজশক্তিকে তোমরা গায়ের জোরে টলাতে পারো একি তুমি সত্যিই বিশ্বাস করো দাদা?

২৩৭