পাতা:পথের দাবী - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/২৫০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

তোমার কার্য্যক্ষেত্র বেছে নিয়েচ? যার। শত অত্যাচারে জর্জ্জরিত, তাদের উত্তেজিত করে তোলা কঠিন নয়, কিন্তু একটা কথা কি ভেবে দেখচ? এইসব নিরীহ অজ্ঞান চাষাভুষোর দুঃখ এমনিই ত যথেষ্ট, তার উপরে আবার কাটাকাটি রক্তারক্তি বাধিয়ে দিলে ত সে দুঃখের আর অবধি থাকবে না।

 ডাক্তার কহিলেন, নিরীহ চাষাভুষোর জন্যে তোমার দুশ্চিন্তার প্রয়োজন নেই ভারতী, কোন দেশেই তারা স্বাধীনতার কাজে যোগ দেয় না। বরঞ্চ, বাধা দেয়! তাদের উত্তেজিত করবার মত পণ্ডশ্রমের সময় নেই আমার। আমার কারবার শিক্ষিত, মধ্যবিত্ত, ভদ্র-সন্তানদের নিয়ে। কোনদিন যদি আমার কাজে যোগ দিতে চাও ভারতী, এ কথাটা ভুলো না আইডিয়ার জন্যে প্রাণ দিতে পারার মত প্রাণ, শান্তিপ্রিয়, নির্ব্বিরোধী নিরীহ কৃষকদের কাছে আশা করা বৃথা। তারা স্বাধীনতা চায় না, শান্তি চায়। যে শান্তি অক্ষম, অশক্তের,—সেই পঙ্গুর জড়ত্বই তাদের ঢের বেশি কামনার বস্তু।

 ভারতী ব্যাকুল হইয়া বলিয়া উঠিল, আমিও তাই চাই দাদা, আমাকে বরঞ্চ এই জড়ত্বের কাজেই তুমি নিযুক্ত করে দাও, তোমার পথের দাবীর ষড়যন্ত্রের বাষ্পে নিশ্বাস আমার রুদ্ধ হয়ে আসছে।

 সব্যসাচী হাসিয়া বলিলেন, আচ্ছা।

 ভারতী থামিতে পারিল না, তেমনি ব্যগ্র উচ্ছ্বাসে বলিয়া উঠিল, ঐ একটা আচ্ছার বেশি আর কি কিছুই বলবার নেই দাদা?

 কিন্তু আমরা যে এসে পড়েচি ভারতী, একটুখানি সাবধানে বোসো দিদি, যেন আঘাত না লাগে—এই বলিয়া ডাক্তার ক্ষিপ্রহস্তে হাতের দাঁড় দিয়া ধাক্কা মারিয়া তাঁহার ছোট্ট নৌকা খানিকে অন্ধকার তীরের মধ্যে প্রবিষ্ট করাইয়া দিলেন। তাড়াতাড়ি উঠিয়া আসিয়া হাত ধরিয়া তাহাকে নামাইতে নামাইতে বলিলেন, জলকাদা নেই বোন, কাঠ পাতা আছে, পা দাও।

 অন্ধকারে অজানা ভূ-পৃষ্ঠে হঠাৎ পা ফেলিতে ভারতীর দ্বিধা হইল, কিন্তু পা দিয়া সে তৃপ্তির নিশ্বাস ফেলিয়া কহিল, দাদা, তোমার হাতে আত্মসমর্পণ করার মত নির্ব্বিঘ্ন স্বস্তি আর নেই—

 কিন্তু অপর পক্ষ হইতে এ মন্তব্যের উত্তর আসিল না। উভয়ে অন্ধকারে কিছুদূর অগ্রসর হইলে ডাক্তার বিস্মরের কণ্ঠে কহিলেন, কিন্তু ব্যাপার কি বল ত? এ কি বিয়ে-বাড়ি? না আছে আলো, না আছে চীৎকার—না শোনা যায় বেহালার সুর,—কোথাও গেল নাকি এরা?

 আরও কিছুদূর আসিয়া চোখে পড়িল, সিঁড়ির উপরের সেই চিত্র-বিচিত্র

২৪৬