পাতা:পথের দাবী - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/২৫৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

 ডাক্তার বিস্মিতচক্ষে তাহার প্রতি চাহিলেন, কিন্তু ভারতী গ্রাহ্য করিল না। বলিতে লাগিল, শশীবাবু, সাংসারিক বুদ্ধি আপনার কম। কিন্তু আমার ত কম ছিল না? সুমিত্রাদিদির বুদ্ধির তুলনাই হয় না। অথচ, কিছুই তা কারও কাজে লাগেনি। এ শুধু পরাভূত হল, দাদা, তোমার বুদ্ধির কাছে। যে চিরদিন অজেয়, পথ যার কখনো বাধা পায়নি, সেও তোমারই পাষাণ দ্বারে কেবল আছাড় খেয়ে খান খান হয়ে পড়ে গেল,—প্রবেশ করার এতটুকু পথ পেলে না!

 ডাক্তার এ অভিযোগের উত্তর দিলেন না, শুধু তাহার মুখপানে চাহিয়া একটুখানি হাসিলেন। ভারতী বলিল, শশীবাবু, আমি আপনার প্রতি মহা অপরাধ করেচি, আজ তার ক্ষমা চাই—

 শশী বুঝিতে পারিল না, কিন্তু কুণ্ঠিত হইয়া উঠিল। ভারতী নিমেষমাত্র মৌন থাকিয়া বলিতে লাগিল, একদিন দাদার কাছে বলেছিলাম, কোন মেয়েমানুষেই কোনদিন আপনাকে ভালবাসতে পারে না। সেদিন আপনাকে আমি চিনিনি। আজ মনে হচ্ছে অপূর্ব্ববাবুকে যে ভালবেসেছিল সে আপনাকে পেলে ধন্য হয়ে যেতো। সবাই আপনাকে উপেক্ষা করে এসেছে, শুধু একটি লোক করেনি, সে এই ডাক্তার।

 ডাক্তার অধোমুখে এক টুকরা মাংস হইতে হাড় পৃথক করিবার কার্য্যে ব্যাপৃত ছিলেন, মুখ তুলিবার অবকাশ পাইলেন না। ভারতী তাঁহাকে সম্বোধন করিয়া কহিল, দাদা, মানুষকে চিনে নিতে তোমার ভুল হয় না, তাই সেদিন দুঃখ করে আমার কাছে বলেছিলে, শশী যদি আর কাউকে ভালবাসত। কিন্তু এক দিনও কি তুমি আমাকে সাবধান করে বলে দিতে পারতে না, ভারতী, এতবড় ভুল তুমি করো না! পুরুষের দুই আদর্শ তোমরা দুজনে আমার মুখে বসে,—আজ আমার বিতৃষ্ণার আর অবধি নেই।

 ডাক্তার মাংসখণ্ড মুখে পুরিয়া দিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, অপূর্ব্ব কি বললে শশী?

 জবাব দিল ভারতী। কহিল, মা পীড়িত। চিকিৎসার প্রয়োজন, অতএব টাকা চাই। ফিরে এসে লুকিয়ে গোলামি করলে কেউ জানতে পারবে না। ভয় তলওয়ারকরকে, ভয় ব্রজেন্দ্রকে। কিন্তু, কাকা পুলিশ-কর্ম্মচারী,——সে ব্যবস্থা নিশ্চয়ই হয়ে গেছে। তুমি আমিও বোধ হয় এখন আর বাদ যাবো না। ক্ষুদ্র! লোভী। সঙ্কীর্ণ-চিত্ত ভীরু! ছি!

 ডাক্তার মুচকিয়া হাসিলেন। ধীরে ধীরে বলিলেন, যথার্থ ভাল না বাসলে এমন প্রাণ খুলে যশোগান করা যায় না। কবি, এবার তোমার পালা। বাগ্দেবীকে স্মরণ করে তুমি এবার নবতারার গুণকীর্ত্তন শুরু কর, আমরা অবহিত হই।

২৫১