পাতা:পথের দাবী - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/২৫৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

 ভারতী চকিত হইয়া কহিল, দাদা, তুমি আমাকে তিরস্কার করলে?

 ডাক্তার ঘাড় নাড়িয়া কহিলেন, তাই হবে হয়ত।

 অভিমানে, ব্যথায়, ক্রোধে ভারতীর মুখ আরক্ত হইয়া উঠিল, বলিল, তুমি কখ্‌খনো আমায় বকতে পাবে না। ভেবেচ সবাই শশীবাবুর মত মুখ বুঁজে সইতে পারে? তুমি কি জানো কি হয় মানুষের? উচ্ছ্বসিত বেদনায় কণ্ঠস্বর তাহার অবরুদ্ধ হইয়া আসিল, কহিল, তিনি ফিরে এসেচেন, এবার আমাকে তুমি কোথাও সরিয়ে নিয়ে যাও দাদা,—আমি এ কোন্ দুর্ভাগ্যের পায়ে আমার সমস্ত বিসর্জ্জন দিয়ে বসে আছি। বলিতে বলিতে মেঝের উপর মাথা রাখিয়া ভারতী ছেলেমানুষের মত কাঁদিয়া ফেলিল।

 ডাক্তার স্থিতমুখে নীরবে আহার করিতে লাগিলেন। তাঁর নির্ব্বিকার ভাব দেখিয়া মনে হয় না যে, এই সকল প্রণয় উচ্ছ্বাস তাঁহাকে লেশমাত্র বিচলিত করিয়াছে। মিনিট পাঁচ-সাত পরে ভারতী উঠিয়া পাশের ঘরে গিয়া চোখ মুখ ভাল করিয়া ধুইয়া মুছিয়া যথাস্থানে ফিরিয়া আসিয়া বসিল। জিজ্ঞাসা করিল, দাদা, আর তোমাদের কিছু দেব?

 ডাক্তার পকেট হইতে রুমাল বাহির করিয়া বলিলেন, বামুনের ছেলে, কিছু ছাঁদা বেঁধে দাও, দিন দুই যেন নিশ্চিন্ত হইতে পারি।

 ময়লা রুমালটা ফিরাইয়া দিয়া ভারতী খোঁজ করিয়া একখানা ধোয়া তোয়ালে বাহির করিল এবং রকমারি খাদ্যবস্তুর একটি পুঁটুলি বাঁধিয়া ডাক্তারের পাশে রাখিয়া দিয়া কহিল, এই ত হল বামুনের ছেলের ছাঁদা। আর ঐ টাকার ছোট্ট থলিটি?

 ডাক্তার সহাস্যে কহিলেন, ওটি হল বামুনের ছেলের ভোজন দক্ষিণা।

 ভারতী বলিল, অর্থাত্‍ তুচ্ছ বিবাহ ব্যাপারটা ছাড়া আসল দরকারি কাজগুলো সমস্তই নির্ব্বিঘ্নে সমাধা হল।

 অকস্মাৎ হাঃ হাঃ—করিয়া আরম্ভ করিয়াই ডাক্তার সজোরে হাত দিয়া নিজের মুখ চাপিয়া ধরিয়া হাসি থামাইলেন, গম্ভীর হইয়া কহিলেন, কি যে ভগবানের অভিশাপ, ভারতী, হাসতে গেলেই মুখ দিয়ে আমার অট্টহাসি ছাড়া আর কিছু বার হতেই চায় না। অট্টকান্না কাঁদবার জন্যে তোমাকে সঙ্গে না নিয়ে এলে আজ মুখ দেখানোই ভার হতো।

 দাদা। আবার জ্বালাতন করচ?

 জ্বালাতন করচি। আমি ত কৃতজ্ঞতা প্রকাশের চেষ্টা করচি।

 ভারতী রাগ করিয়া আর একদিকে মুখ ফিরাইল, জবাব দিল না।

২৫২