পাতা:পথের দাবী - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/২৫৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

 বরাবর চুপ করিয়াই ছিল, এতক্ষণে কথা কহিল। অকস্মাৎ অতিশয় গাম্ভীর্য্যের সহিত বলিল, আপনি যদি রাগ না করেন ত একটা কথা বলতে পারি। কেউ কেউ ভয়ানক সন্দেহ করে যে, আপনার সঙ্গেই একদিন ভারতীর বিবাহ হবে।

 ডাক্তার মুহূর্ত্তের জন্য চমকিত হইলেন, কিন্তু পরক্ষণেই আত্মসম্বরণ করিয়া উল্লাসভরে বলিয়া উঠিলেন, বল কি হে শশী, তোমার মুখে ফুল চন্দন পড়ুক, এমন সুদিন কি কখনো এতবড় দুর্ভাগার অদৃষ্টে হবে? এ যে স্বপ্নের অতীত, কবি!

 শশী কহিল, কিন্তু অনেকে ত তাই ভাবেন।

 ডাক্তার কহিলেন, হায়! হায়! অনেকে না ভেবে যদি একটি মাত্র লোক একটি পলকের জন্য ও ভাবতেন।

 ভারতী হাসিয়া ফেলিল! মুখের দিকে চাহিয়া বলিল, দুর্ভাগার ভাগ্য ত একটি পলকেই বদলাতে পারে দাদা। তুমি হুকুম করে যদি বল, ভারতী, কালই আমাকে তোমার বিয়ে করতে হবে, আমি তোমার দিব্যি করে বলচি, বলব না যে আর একটা দিন সবুর কর।

 ডাক্তার কহিলেন, কিন্তু বেচারা যে প্রাণের মায়া তুচ্ছ করে ফিরে এল, তার উপায়টা কি হবে?

 ভারতী বলিল, তাঁর কনে-বৌ দেশে মজুত আছে, তাঁর জন্যে তোমার দুশ্চিন্তার কারণ নেই। তিনি বুক ফেটে মারা যাবেন না।

 ডাক্তার গম্ভীর হইয়া কহিলেন, কিন্তু আমাকে বিয়ে করতে রাজি হয়ে যাও, তোমার ভরসা ত কম নয় ভারতী!

 ভারতী কহিল, তোমার হাতে পড়ব তার আর ভয়টা কিসের?

 ডাক্তার শশীর প্রতি চাহিয়া বলিলেন, শুনে রেখো কবি। ভবিষ্যতে যদি অস্বীকার করে তোমাকে সাক্ষী দিতে হবে।

 ভারতী বলিল, কাউকে সাক্ষী দিতে হবে না দাদা, আমি তোমার নাম নিয়ে এত বড় শপথ কথনো অস্বীকার কোরব না। শুধু তুমি স্বীকার করলেই হয়।

 ডাক্তার কহিলেন, আচ্ছা দেখে নেবো তখন।

 দেখো। এই বলিয়া ভারতী হাসিয়া কহিল, দাদা, আমিই বা কি, আর সুমিত্রাই বা কি,—স্বর্গের ইন্দ্রদেব যদি ঊর্ব্বশী মেনকা রম্ভাকে ডেকে বলতেন সেকালের মুনি-ঋষিদের বদলে তোমাদের একালের সব্যসাচীর তপস্যা ভঙ্গ করতে হবে ত আমি নিশ্চয় বলচি দাদা, মুখে কালি মেখে তাদের ফিরে যেতে হ’তো। রক্ত-মাংসের হৃদয় জয় করা যায়, কিন্তু পাথরের সঙ্গে কি চলে। পরাধীনতার আগুনে পুড়ে সমস্ত বুকে তোমার একেবারে পাষাণ হয়ে গেছে?

২৫৩