পাতা:পথের দাবী - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/২৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

 অপুর্ব্ব কিছুক্ষণ নিঃশব্দে আহার করার পরে হঠাৎ মুখ তুলিয়া কহিল, আর ঐ মেয়েটা কি বজ্জাত, তেওয়ারী? কাল এলো যেন ভিজে বেড়ালটি, আর ওপরে গিয়েই যত সব মিছে কথা লাগিয়েচে! চেনা ভার!

 তেওয়ারী কহিল, খিষ্টান যে!

 তা বটে! অপূর্ব্বর তৎক্ষণাৎ মনে হইল, ইহাদের খাদ্যাখাদ্যের জ্ঞান নাই, এঁটোকাঁটা মানে না, সামাজিক ভাল-মন্দের কোন বোধ নাই,—কহিল, হতভাগা, নচ্ছার ব্যাটারা। জানিস তেওয়ারী, আসল সাহেবরা এদের কি রকম ঘেন্না করে—এক টেবিলে বসে কখনো খায় না পর্য্যন্ত—যতই হ্যাটকোট পরুন, আর যতই কেননা গির্জ্জেয় আনাগোনা করুন। যারা জাত দেয়, তারা কি কখ্‌খনো ভাল হতে পারে তুই মনে করিস?

 তেওয়ারী তাহা কোন দিনই মনে করে না, কিন্তু নিজেদের এই আসন্ন সর্ব্বনাশের সম্মুখে দাঁড়াইয়া অপরে কে ভাল আর কে মন্দ, এ আলোচনায় তাহার প্রবৃত্তি হইল না। ছোটবাবুর আফিসে যাইবার সময় হইয়া আসিতেছে, তখন একাকী ঘরের মধ্যে যে কি করিয়া তাহার সময় কাটিবে সে জানে না। সাহেব থানায় খবর দিতে গিয়াছে ফিরিয়া আসিয়া হয়ত দোর ভাঙিয়া ফেলিবে, হয়ত পুলিশের দল সঙ্গে করিয়া আনিবে,—হয়ত তাহাকে বাঁধিয়া লইয়া যাইবে,—কি যে হইবে, আর কি যে হইবে না সমস্ত অনিশ্চিত। এ অবস্থায় আসল ও নকল সাহেবের প্রভেদ কতখানি, একের টেবিলে অপরে খায় কি না, এবং না খাইলে অন্যপক্ষের লাঞ্ছনা ও মনস্তাপ কতদুর বৃদ্ধি পায়, এ-সকল সংবাদের প্রতি সে লেশমাত্র কৌতূহল অনুভব করিল না। আহারাদি শেষ করিয়া অপুর্ব্ব কাপড় পরিতেছিল, তেওয়ারী ঘরের পর্দ্দাটা একটুখানি সরাইয়া মুখ বাহির করিয়া কহিল, একটু দেখে গেলে হ’ত না?

 কি দেখে গেলে?

 ওদের ফিরে আসা পর্য্যন্ত—

 অপূর্ব্ব কহিল, অ কি হয়! আজ আমার চাকরির প্রথম দিন,—কি তারা ভাববে বল্‌ত?

 তেওয়ারী চুপ করিয়া রহিল। অপূর্ব্ব কহিল, তুই দোর দিয়ে নির্ভয়ে বসে থাক্‌ না,—আমি যত শীঘ্র পারি ফিরে আসবো—দোর ত আর ভাঙতে পারবে না, কি করবে ব্যাটা!

 তেওয়ারী কহিল, আচ্ছা। কিন্তু সে যে একটা দীর্ঘশ্বাস চাপিবার চেষ্টা করিল অপূর্ব্ব তাহা স্পষ্ট দেখিতে পাইল। বাহির হইবার সময়ে দ্বারে খিল দেয়ার পূর্ব্বে

২২