পাতা:পথের দাবী - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/২৬২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

ডাক্তার। যে তিনজন বাঙালী মহিলাকে আপনি নিলেন—নবতারা গেলেন, স্বয়ং প্রেসিডেণ্ট যেতে উদ্যত, শুধু ভারতী—

 ডাক্তার সহাস্যে বলিলেন, তোমার দুশ্চিন্তার হেতু নেই, কবি, ভারতীও মহাজনের পন্থা অনুসরণ করবেন তা এক প্রকার স্থির হয়ে গেছে।

 প্রত্যুত্তরে ভারতী শুধু ক্রুদ্ধ কটাক্ষ নিক্ষেপ করিল, কিন্তু জবাব দিল না।

 ডাক্তারের পরিহাসের মধ্যে যে ব্যথা আছে শশী ইহাই অনুমান করিয়া কহিল, আপনাকেও শীঘ্র চলে যেতে হচ্চে। তাহলেই দেখুন, আপনার পথের দাবীর এ্যাক্‌টিভিটি বর্ম্মায় অন্ততঃ শেষ হয়ে গেল। কে আর চালাবে! এই বলিয়া শশী গভীর নিশ্বাস মোচন করিল। তাহার এই দীর্ঘশ্বাস অকৃত্রিম এবং যথার্থই বেদনায় পূর্ণ, কিন্তু আশ্চর্য্য এই যে, ডাক্তারের মুখের ’পরে ইহার লেশমাত্র প্রতিবিম্ব পড়িল না। তেমনি হাসিমুখে কহিলেন, ও কি কথা কবি? এতকাল এত দেখে শুনে শেষে তোমারই মুখে সব্যসাচীর এই সার্টিফিকেট! তিনজন মহিলা চলে যাবেন বলে পথের দাবী শেষ হয়ে যাবে? মদ ছেড়ে দিয়ে কি এই হ’ল নাকি? তার চেয়ে তুমি বরঞ্চ আবার ধরো।

 কথাটা তামাসার মত শুনাইলেও যে তামাসা নয় তাহা বুঝিয়াও ভারতী ঠিকমত বুঝিতে পারিল না। কটাক্ষে চাহিয়া দেখিল, সুমিত্রা নতনেত্রে নিঃশব্দে বসিয়া আছে। তখন সে মুখ তুলিয়া ডাক্তারের মুখের প্রতি স্থির দৃষ্টিপাত করিয়া বলিল, দাদা, আমার ত আর বোঝবার জন্যে মদ ধরবার আবশ্যক নেই, কিন্তু তবু ত বুঝতে পারলাম না। নবতারা কিছুই নয়, আর আমি তার চেয়েও অকিঞ্চিৎকর, কিন্তু সুমিত্রা দিদি—যাঁকে তুমি নিজে থেকে প্রেসিডেণ্টের আসন দিয়েচ,—তিনি চলে গেলেও কি তোমার পথের দাবীতে আঘাত লাগবে না? সত্যি কথা বোলো দাদা সুদ্ধমাত্র কাউকে লাঞ্ছনা করবার জন্যেই রাগ করে যেন বোলো না! এই বলিয়া সে চোখাচোখি হইবার নিঃসন্দিগ্ধ ভরসায় পলকমাত্র সুমিত্রার প্রতি দৃষ্টিপাত করিয়াই চক্ষু অন্যত্র অপসারিত করিল। চোখে চোখে মিলল না। সুমিত্রা সেই যে মুখ নীচু করিয়া বসিয়া ছিল, ঠিক তেমনি নির্ব্বাক নতমুখে মূর্ত্তির মত বসিয়া রহিল।

 ডাক্তার ক্ষণকাল মৌন হইয়া রহিলেন, তাহার পরে ধীরে ধীরে কহিলেন, আমি রাগ করে বলিনি ভারতী, সুমিত্রা অবহেলার বস্তু নয়। কিন্তু তুমি হয় ত জানো না, কিন্তু নিজে সুমিত্রা ভালরূপেই জানেন যে এ সকল ব্যাপারে আমাদের ক্ষতির পরিমাণ গণনা করতে নেই। তাছাড়া প্রাণ যাদের এমন অনিশ্চিত তাদের মূল্য স্থির হবে কি দিয়ে বল ত? মানুষ ত যাবেই। যত বড় হোক, কারও অভাবকেই যেন না আমরা সর্ব্বনাশ বলে ভাবি, একজনের স্থান যেন জলস্রোতের মত আর

২৫৮