পাতা:পথের দাবী - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/২৬৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

একজন স্বচ্ছন্দে এবং অত্যন্ত অনায়াসেই পূর্ণ করে নিতে পারে এই শিক্ষাই ত আমাদের প্রথম এবং প্রধান শিক্ষা ভারতী।

 ভারতী কহিল, কিন্তু এ তো আর সংসারে সত্যই ঘটে না। এই যেমন তুমি। তোমার অভাব কেউ কোনদিন পূর্ণ করতে পারে এ-কথা তো আমি ভাবতে পারিনে দাদা!

 ডাক্তার বলিলেন, তোমার চিন্তার ধারা স্বতন্ত্র ভারতী। আর, এই যেদিন টের পেয়েছিলাম, সেই দিন থেকেই তোমাকে আর আমি দলের মধ্যে টানতে পারিনি। কেবল মনে হয়েচে, জগতে তোমার অন্য কাজ আছে।

 ভারতী বলিল, আর কেবলই আমার মনে হয়েচে আমাকে অযোগ্য জ্ঞানে তুমি দূরে সরিয়ে দিতে চাচ্চো। যদি আমার অন্য কাজ থাকে, আমি তারই জন্যে এখন থেকে সংসারে বার হবো, কিন্তু আমার প্রশ্নের ত জবাব হল না দাদা। আসলে কথাটা তুচ্ছ। তোমার অভাব জলস্রোতের মতই পূর্ণ হতে পারে কি না? তুমি বোলচ পারে—আমি বলচি, পারে না। আমি জানি পারে না, আমি জানি মানুষ শুধু জলস্রোত নয়,—তুমি ত নও-ই।

 মুহূর্ত্তকাল মৌন থাকিয়া সে পুনশ্চ কহিল, কেবল এই কথাটাই জানবার জন্যে তোমাকে আমি পীড়াপীড়ি করতাম না। কিন্তু যা নয়, যা নিজে জানো তুমি সত্য নয়, তাই দিয়ে আমাকে ভোলাতে চাও কেন?

 ডাক্তার হঠাৎ উত্তর দিতে পারিলেন না, উত্তরের জন্য ভারতী অপেক্ষাও করিল না। কহিল, এদেশে আর তোমার থাকা চলে না,—তুমিও যাবার জন্যে পা তুলে আছো। আবার তোমাকে ফিরে পাওয়া যে কত অনিশ্চিত এ-কথা ভাবতেও বুকের মধ্যে জ্বলতে থাকে, তাই ত আমি ভাবিনে, তবুও এ সত্য ত প্রতি মুহূর্ত্তেই অনুভব না করে পারিনে। এ ব্যথার সীমা নেই, কিন্তু তার চেয়েও আমার বড় ব্যথা তোমাকে এমন করে পেয়েও পেলাম না! আজ আমার কত দিনের কত প্রশ্নই মনে হচ্ছে দাদা, কিন্তু যখনি জিজ্ঞাসা করেচি তুমি সত্য বলেচ, মিথ্যা বলেচ, সত্যে-মিথ্যায় জড়িয়ে দিয়ে বলেছ,—কিন্তু কিছুতেই সত্য জানতে দাওনি; তোমার পথের দাবীর সেক্রেটারী আমি, তবু যে তোমার কাজের পদ্ধতিতে আমার এতটুকু আস্থা ছিল না, এ-কথা তোমাকে ত আমি একটা দিনও লুকোইনি। তুমি রাগ করোনি, অবিশ্বাস করোনি—হাসিমুখে শুধু বার বার সরিয়ে দিতে চেয়েচ। অপূর্ব্ববাবুর জীবন-দানের কথা আমি ভুলিনি। মনে হয়, আমার ছোট্ট জীবনের কল্যাণ কেবল তুমিই নির্দ্দেশ করে দিতে পারো। দোহাই দাদা, যাবার পূর্ব্বে

২৫৯