পাতা:পথের দাবী - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/২৬৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

এ অধীনতা অনেক দুঃখের মূল।

 শশী ধীরে ধীরে কহিল, এসব আপনি কি বলছেন?

 ভারতীর ক্ষোভের অবধি রহিল না, বলিল, দাদা, আজ আমি ক্রীশ্চান, কিন্তু তাঁরা আমারও পূর্ব্বপিতামহ। তাদের আর যা দোষ থাক, ধর্ম্ম-বিশ্বাসে প্রবঞ্চনা ছিল,—এরকম অন্যায় কটূক্তি তুমি কোরো না।

 সুমিত্রা চুপ করিয়াই শুনিতেছিল, এখন কথা কহিল। ভারতীর প্রতি চাহিয়া বলিল, কারও সম্বন্ধেই কটূক্তি করা অন্যায়, কিন্তু অশ্রদ্বেয়কে শ্রদ্ধা করাও অন্যায়, এমন কি তিনি পূর্ব্বপিতামহ হলেও। এতে মিষ্টতা থাকতে পারে, কিন্তু যুক্তি নেই ভারতী, যা কুসংস্কার তাকে পরিত্যাগ করতে শেখো।

 ভারতী নির্ব্বাক হইয়া রহিল। ডাক্তার শশীকে উদ্দেশ করিয়া বলিলেন, কোন বস্তু কেবল মাত্র প্রাচীনতার জোরেই সত্য হয়ে ওঠে না, কবি। পুরাতনের গুণগান করতে পারাই বড় গুণ নয়। তাছাড়া, আমরা বিপ্লবী, পুরাতনের মোহ আমাদের জন্যে নয়। আমাদের দৃষ্টি আমাদের গতি, আমাদের লক্ষ্য শুধু সুমুখের দিকে। পুরাতনের ধ্বংস করেই ত শুধু আমাদের পথ করতে হয়! এর মধ্যে মায়া-মমতার অবকাশ কই? জীর্ণ মৃত পথ জুড়ে থাকলে আমরা পথের দাবীর পথ পাবো কেথায়?

 ভারতী কহিল, আমি কেবল তর্কের জন্যেই তর্ক করচিনে, আমি সত্যই তোমার কাছ থেকে আমার জীবনের পথ খুঁজে বেড়াচ্চি। তুমি পুরাতনের শত্রু, কিন্তু কোন একটা সংস্কার বা রীতিনীতি কেবল মাত্র প্রাচীন হয়েছে বলেই কি তা নিষ্ফল, বৃথা এবং পরিত্যজ্য হয়ে যাবে? মানুষে তা হলে অসংশয়ে ভর দিয়ে দাঁড়াবে কার ’পরে দাদা?

 ডাক্তার বলিলেন, এতখানি ভারসহ বস্তু দুনিয়ায় কি আছে তা জানিনে। তবে এ কথা জানি, ভারতী, বয়সের সঙ্গে একদিন সমস্ত জিনিসই প্রাচীন, জীর্ণ এবং অকেজো, সুতরাং পরিত্যজ্য হয়ে ওঠে। প্রত্যহ মানুষেই এগিয়ে যাবে, আর তার পিতামহের প্রতিষ্ঠিত সহস্র বর্ষের প্রচীন রীতিনীতি একই স্থানে অচল হয়ে থাকবে, এমন হলে হয়ত ভাল হয়, কিন্তু তা হয় না। শুধু একটা বিপদ হয়েছে এই যে, কেবল মাত্র বছরের সংখ্যা দিয়েই কোন একটা সংস্কারের প্রাচীনতা নিরূপণ করা যায় না। না হলে তুমিও আজ আমাদের সঙ্গে গলা মিলিয়ে বলতে, দাদা, যা কিছু পুরাতন, যা কিছু জীর্ণ সমস্ত নির্ব্বিচারে নির্ম্মম হয়ে ধ্বংস করে ফেলো, আবার নূতন মানুষ নূতন জগতের প্রতিষ্ঠা হোক।

 ভারতী জিজ্ঞাসা করিল, দাদা, নিজে তুমি পারো?

 কি পারি, বোন?

২৬৪