পাতা:পথের দাবী - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/২৭২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

সমস্ত লক্ষ্যই আর কিছু—এ কথা নিঃসঙ্কোচে স্বীকার করিয়া লইতে সব্যসাচীর কোন দ্বিধা, কোন লজ্জা নাই! পরাধীন দেশের মুক্তিযাত্রায় আবার পথের বাচ বিচার কি? একদিন সব্যসাচী বলিয়াছিলেন, পরাধীন দেশে শাসক এবং শাসিতের নৈতিক বুদ্ধি যখন এক হইয়া দাঁড়ায় তাহার চেয়ে বড় দুর্ভাগ্য আর দেশের নাই, ভারতী! সেইদিন একথার তাৎপর্য্য সে বুঝিতে পারে নাই, আজ সে অর্থ তাহার কাছে পরিস্ফুট হইয়া উঠিল।

 ঘড়িতে তিনটা বাজিয়া গেল। ইহার পরে কখন যে তাহার চৈতন্য নিদ্রায় ও তন্দ্রায় আবিষ্ট হইয়া পড়িল তাহার মনে নাই, কিন্তু মনে পড়িল নিদ্রার ঘোরে সে বার বার আবৃত্তি করিয়াছে, দাদা, অতিমানুষ তুমি, তোমার ’পরে ভক্তি-শ্রদ্ধা স্নেহ আমার চিরদিনই অচল হয়ে থাকবে, কিন্তু তোমার এ বিচার-বুদ্ধি আমি কোনমতেই গ্রহণ করতে পারব না। জগদ্বীশ্বর করুন, তোমার হাত দিয়েই যেন তিনি স্বদেশের মুক্তি দান করেন, কিন্তু অন্যায়কে কখনও ন্যায়ের মুক্তি দিয়ে দাঁড় করিয়ো না। তুমি পরম পণ্ডিত, তোমার বুদ্ধির সীমা নেই, তর্কে তোমাকে এঁটে ওঠা যায় না,—তুমি সব পারো। বিদেশীর হাতে পরাধীনের লাঞ্ছনা যে কত, দুঃখের সমুদ্রে কত যে আমাদের প্রয়োজন, দেশের মেয়ে হয়ে সে কি আমি জানিনে দাদা? কিন্তু তাই বলে প্রয়োজনকেই যদি সকলের শীর্ষে স্থান দিয়ে দুর্ব্বলচিত্ত মানবের কাছে অধর্ম্মকেই ধর্ম্ম বলে সৃষ্টি কর, এ দুঃখের আর কখনো তুমি অন্ত পাবে না।

 পরদিন ভারতীর যখন ঘুম ভাঙিল, তখন বেলা হইয়াছে। ছেলেরা দ্বারের বাহিরে দাঁড়াইয়া ডাকাডাকি করিতেছে। সে তাড়াতাড়ি হাত-মুখ ধুইয়া নীচে আসিয়া কপাট খুলিতেই জনকয়েক ছাত্র ও ছাত্রী বই-শ্লেট লইয়া ভিতরে ঢুকিল। তাহাদের বসিতে বলিয়া ভারতী কাপড় ছাড়িতে উপরে যাইতেছিল, হোটেলের মালিক সরকার ঠাকুর আসিয়া উপস্থিত হইল। কহিল, অপূর্ব্ববাবু তোমাকে কাল রাত থেকে খুঁজছেন দিদি।

 ভারতী ফিরিয়া দাঁড়াইয়া জিজ্ঞাসা করিল, রাতে এসেছিলেন?

 ঠাকুর মহাশয় কহিল, হাঁ আজও সকাল থেকে বসে আছেন, গিয়ে পাঠিয়ে দিগে?

 ভারতীর মুখ পলকের জন্য শুষ্ক হইয়া উঠিল, কহিল, আমাকে তাঁর কি দরকার?

 ব্রাহ্মণ বলিল, সে তো জানিনে দিদি। বোধ হয় তাঁর মায়ের অসুখের সম্বন্ধেই কিছু বলতে চান।

 ভারতী হঠাৎ রুষ্ট হইয়া উঠিল, বলিল, কোথায় তার মায়ের কি অসুখ হয়েচে তার আমি কি কোরব?

২৬৮