পাতা:পথের দাবী - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/২৭৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

করার মত সর্ব্বনাশ আর নাই। এ সমস্তই ভারতী জানিত,—সে ইহাও জানিত জননীকে অপূর্ব্ব কতখানি ভালবাসে। মায়ের জন্য করিতে পারে না পৃথিবীতে এমন তাহার কিছুই নাই। তাঁহারই কাছে না যাইতে পারার দুঃখ অপূর্ব্বর কত, ইহাই কল্পনা করিয়া একদিকে যেমন তাহার করুণার উদয় হইল, অন্যদিকে এই অসহ্য ভীরুতার ক্রোধে তাহার সর্ব্বাঙ্গ জ্বলিতে লাগিল। ভারতী মনে মনে বলিল, শুশ্রূষা করিতে পারে না বলিয়াই কি পীড়িতা মায়ের কাছে গিয়া কোন লাভ নাই? এই উপদেশ আমার কাছে অপূর্ব্ব প্রত্যাশা করে নাকি?

 এমন করিয়া এই দিক দিয়াই তাহার চিন্তার ধারা অবিশ্রাম প্রবাহিত হইতে লাগিল। মাতার অসুখের সম্বন্ধে অপূর্ব্বর আর কিছু যে জিজ্ঞাস্য থাকিতে পারে, এ ছাড়া অন্য কিছু যে ঘটিতে পারে যাহা তাহার প্রত্যাবর্ত্তনের পথ রুদ্ধ করিয়াছে, উহার আভাস পর্য্যন্ত তাহার মাথায় প্রবেশ করিল না।

 ক্ষুধার লেশমাত্র ছিল না বলিয়া আজ ভারতী রাঁধিবার চেষ্টা করিল না। বেলা যখন তৃতীয় প্রহর উত্তীর্ণ হইয়াছে, একখানা ঘোড়ার গাড়ি আসিয়া তাহার দ্বারে লাগিল। ভারতী উপরের জানালা দিয়া মুখ বাড়াইয়া দেখিয়া বিস্ময় ও শঙ্কায় পরিপূর্ণ হইয়া উঠিল। মোট ঘাট গাড়ির ছাদে চাপাইয়া শশী আসিয়া উপস্থিত। গত রাত্রের হাসি-তামাসাকে জগতে যে কোন মানুষই এমন বাস্তবে পরিণত করিয়া তুলিতে পারে, ভারতী বোধ হয় তাহা কল্পনাও করিতে পারিত না। কিন্তু ইহার কাছে অভাবনীয় কিছু নাই। রহস্য একেবারে মূর্ত্তিমান সত্যরূপে সশরীরে আসিয়া হাজির হইল।

 ভারতী দ্রুতপদে নীচে নামিয়া গিয়া কহিল, একি ব্যাপার শশীবাবু?

 শশী স্মিতমুখে কহিল, বাসা তুলে দিয়ে এলাম। এবং তৎক্ষণাৎ গাড়োয়ানকে হুকুম করিয়া দিল, সামান সব কুছ্ উপরমে লে যাও—

 ভারতী বিরক্তি দমন করিয়া কহিল, উপরে জায়গা কোথায় শশীবাবু?

 শশী কহিল, আচ্ছা বেশ, তাহলে নীচের ঘরেই রাখুক।

 ভারতী বলিল, নীচের ঘরে পাঠশালা, সেখানেও সুবিধে হবে না।

 শশী চিন্তিত হইয়া উঠিল। ভারতী তাহাকে ভরসা দিয়া কহিল, এক কাজ করা যাক শশীবাবু। হোটেলে ডাক্তারের ঘরটা ত আজও খালি পড়ে আছে, আপনি সেখানেই বেশ থাকবেন। খাওয়া-দাওয়ারও কষ্ট হবে না, চলুন।

 কিন্তু ঘরের ভাড়া লাগবে ত?

 ভারতী হাসিয়া ফেলিল, কহিল, না, তাও লাগবে না, ছয়মাসের ভাড়া দাদা দিয়ে গেছেন।

২৭০