পাতা:পথের দাবী - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/২৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

তলওয়ারকরকে কহিলেন, আপনার ঘরেও এক কপি পাঠিয়ে দিয়েছি। না না, এখন থাক্‌—আজ ম্যানেজারের সম্মানে দু’টোর সময় আফিসের ছুটি। দেখুন, আমি ত শীঘ্রই চলে যাবো তখন আপনাদের দুজনের ’পরেই সমস্ত কাজ-কর্ম্ম নির্ভর করবে। আমি ইংলিশম্যান নই,—যদিচ এ রাজ্য একদিন আমাদেরই হতে পারত,—তবুও তাদের মত আমরা ইণ্ডিয়ানদের ছোট মনে করিনে, নিজেদের সমকক্ষই ভাবি,—কেবল ফার্ম্মের নয়, আপনাদের নিজেদের উন্নতিও আপনাদের নিজেদের কর্ত্তব্য জ্ঞানের উপরে—আচ্ছা, গুড্‌ডে—আফিস দু’টার সময় বন্ধ হওয়া চাই—ইত্যাদি বলিতে বলিতে তিনি যেমন ক্ষিপ্রপদে প্রবেশ করিয়াছিলেন, তেমনি ক্ষিপ্রপদে বাহির হইয়া গেলেন। এবং ইহার অল্পক্ষণ পরেই তাঁহার মোটরের শব্দ বাহিরের দ্বারের কাছে শুনিতে পাওয়া গেল।

 বেলা দুইটার সময় উভয়ে একত্রে পথে বাহির হইল। তলওয়ারকর সহরে থাকে না, প্রায় দশ মাইল পশ্চিমে ইন্‌সিন্ নামক স্থানে তাহার বাসা। বাসায় তাহার স্ত্রী ও একটি ছোট মেয়ে থাকে, সঙ্গে খানিকটা জমি আছে, সেখানে তরি-তরকারী অনায়াসে জন্মাইতে পারা যায়, চমৎকার খোলা জায়গা, সহরের গণ্ডগোল নাই,—যথেষ্ট ট্রেন, যাতায়াতের কোন অসুবিধা হয় না।—হালদার বাবুজী, কাল আফিসের পরে আমার ওখানে চায়ের নিমন্ত্রণ রইল।

 অপূর্ব্ব কহিল, আমি চা খাইনে বাবুজী!

 খান না? আমিও পূর্ব্বে খেতাম না, আমার স্ত্রী এখনও রাগ করেন,—আচ্ছা, না হয়, ফলমূল—সরবৎ—কিংবা—আমরা ত আপনার মতই ব্রাহ্মণ—

 অপূর্ব্ব হাসিয়া কহিল, ব্রাহ্মণ ত বটেই। কিন্তু আপনারা যদি আমাদের হাতে খান, তবেই আমি শুধু আপনার স্ত্রীর হাতে খেতে পারি।

 রামদাস কহিল, আমি ত খেতে পারিই, কিন্তু আমার স্ত্রীর কথা—আচ্ছা সে তাঁকে জিজ্ঞেস করে বলব। আমাদের মেয়েরা বড়,—আচ্ছা, আপনার বাসা ত কাছেই, চলুন না আপনাকে পৌঁছে দিয়ে আসি। আমার ট্রেন ত সেই পাঁচটায়।

 অপূর্ব্ব প্রমাদ গনিল। এতক্ষণ সে সমস্ত ভুলিয়াছিল, বাসার কথায় চক্ষের নিমিষে তাহার সমস্ত হাঙ্গামা, সমস্ত কদর্য্যতা বিদ্যুৎ-স্ফূরণের ন্যায় চমকিয়া মুখের সরসশ্রী মুছিয়া দিয়া গেল। এখানে পা দিয়াই সে এমন একটা কদর্য্য নোঙরা ব্যাপারে লিপ্ত হইয়া পড়িয়াছে, এ-কথা জানিতে দিতে তাহার মাথা কাটা গেল। এতক্ষণ সেখানে যে কি হইয়াছে সে কিছুই জানে না। হয়ত, কত কি হইয়াছে। একাকী তাহারই মাঝখানে গিয়া দাঁড়াইতে হইবে। এমন একজন পরিচিত মানুষকে সঙ্গে পাইলে কত সুবিধা, কত সাহস। কিন্তু সদ্য পরিচয়ের এই আরম্ভ-

২৪