পাতা:পথের দাবী - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/২৮২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

৩০

 পরিত্যক্ত, পতনোন্মুখ, ঘন বনাচ্ছন্ন যে জীর্ণমঠের মধ্যে একদিন অপূর্ব্বর অপরাধের বিচার হইয়াছিল, আজ আবার সেই কক্ষেই পথের দাবী আহুত হইয়াছে। সে দিনের সেই অবরুদ্ধ গৃহতলে যে দুর্জ্জয় ক্রোধ ও নির্ম্মম প্রতিহিংসার অগ্নি দাউ দাউ করিয়া জ্বলিয়াছিল, আজ তাহার স্ফুলিঙ্গমাত্র নাই। সে বাদী নাই, প্রতিবাদী নাই, কাহারো বিরুদ্ধে কাহারো নালিশ নাই, আজ শঙ্কা ও নৈরাশ্যের দুঃসহ বেদনায় সমস্ত সভা নিষ্প্রভ, বিষণ্ণ, ম্রিয়মাণ। ভারতীর চোখের কোণে অশ্রুবিন্দু—সুমিত্রা অধোমুখে নীরব, স্থির। তলওয়ারকর ধরা পড়িয়াছে; রক্তাক্ত, ক্ষত-বিক্ষত দেহে সে জেলের হাসপাতালে,— আজও তাহার ভাল করিয়া জ্ঞান হয় নাই। তাহার স্ত্রী শিশুকন্যা লইয়া পথে পথে ঘুরিয়া অনেক দুঃখে কাল সন্ধ্যায় কে একজন মারহাট্টি ব্রাহ্মণের গৃহে আশ্রয় পাইয়াছে; সুমিত্রা সন্ধান লইয়া তাহার পিতৃগৃহে আজ তার করিয়াছে, কিন্তু এখনও জবাব আসে নাই।

 ভারতী ধীরে ধীরে জিজ্ঞাসা করিল, তলওয়ারকরবাবুর কি হবে দাদা?

 ডাক্তার কহিলেন, হাসপাতাল থেকে যদি বেঁচে ওঠে জেল খাটবে।

 ভারতী মনে মনে শিহরিয়া উঠিল, বলিল, না বাঁচতেও ত পারেন?

 ডাক্তার কহিলেন, অন্ততঃ অসম্ভব নয়। তারপরে সুদীর্ঘ কারাবাস।

 ভারতী ক্ষণকাল চুপ করিয়া থাকিয়া প্রশ্ন করিল, তাঁর স্ত্রী, তাঁর ছোট্টমেয়ে,— তাদের কি হবে?

 সুমিত্রা এ কথার জবাব দিয়া কহিল, হয়ত দেশ থেকে তাঁর বাপ এসে নিয়ে যাবেন।

 ভারতী বলিল, হয়ত! ধরুন, যদি কেউ না আসেন? যদি কেউ না থাকে?

 ডাক্তার হাসিলেন, বলিলেন, বিচিত্র নয়। সে ক্ষেত্রে মানুষ অকস্মাৎ মারা গেলে তার নিরুপায় বিধবার যে দশা হয়, এদেরও তাই হবে। একটুখানি থামিয়া কহিলেন, আমারা গৃহী নই, আমাদের ধনসম্পদ নেই, বিদেশীর আইনে নিজের জন্মভূমিতে আমাদের মাথা রাখবার ঠাঁই নেই,—বন্য পশুর মত আমরা বনে লুকিয়ে বেড়াই, সংসারীর দুঃখ মোচন করবার ত আমাদের শক্তি নেই ভারতী।

 ভারতী ব্যথিত হইয়া কহিল, তোমাদের নেই, কিন্তু যাঁদের এসব আছে,—আমাদের এ দেশের লোকে কি এঁদের দুঃখ দূর করতে পারে না দাদা?

 ডাক্তার ঈষৎ হাসিয়া বলিলেন, কিন্তু করবে কেন দিদি? তারা ত এ কাজ

২৭৮