পাতা:পথের দাবী - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/২৮৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

শিশু, নারী, সঙ্কোচ নেই,—যে পাপের সীমা হয় না, ভারতী, সেই বিষাক্ত বাষ্পের নরহত্যাতেও নৈতিক বুদ্ধি এদের বাধা দেয় না। উদ্দেশ্য সিদ্ধির প্রয়োজনে যে কোন উপায় যে-কিছু পথই এদের সুপবিত্র। কেবল নীতির বাধা, ধর্ম্মের নিষেধ কি শুধু নির্ব্বাসিত পদদলিত আমারই বেলায়।

 ভারতী নিরুত্তরে বসিয়া রহিল। এই সকল অভিযোগের প্রতিবাদের সে কি জানে? যে নির্ম্মম, একান্ত দৃঢ়চিত্ত, শঙ্কাহীন, ক্ষমাহীন বিপ্লবী, জ্ঞান বুদ্ধি ও পাণ্ডিত্যের যাহার অন্ত নাই, পরাধীনতার অনির্ব্বাণ অগ্নিতে যাহার সমস্ত দেহ মন অহর্নিশ শিখার মত জ্বলিতেছে, যুক্তি দিয়া তাহাকে পরাস্ত করিবার সে কোথায় কি খুঁজিয়া পাইবে? জবাব নাই, ভাষা তাহার মূক হইয়া রহিল, কিন্তু তাহার কলুষ-হীন নারী-হৃদয় অন্ধ করুণায় নিঃশব্দে মাথা খুঁড়িয়া কাঁদিতে লাগিল।

 সুমিত্রা অনেকদিন হইতেই এই সকল বাদ-প্রতিবাদে যোগ দেওয়া বন্ধ করিয়াছিল, আজিও সে অধোমুখে স্তব্ধ হইয়া রহিল, শুধু অসহিষ্ণু হইয়া উঠিল কৃষ্ণ আইয়ার। আলোচনার বহু অংশই সে বুঝিতে পারিতেছিল না, এই নীরবতার মাঝখানে সে জিজ্ঞাসা করিল, আমাদের সভার কাজ আরম্ভ হওয়ার আর বিলম্ব কত?

 ডাক্তার কহিলেন, কোন বিলম্বই নেই। সুমিত্রা, তোমার জাভায় ফিরে যাওয়াই স্থির?

 হাঁ।

 কবে?

 বোধ হয় এই বুধবারে। গত শনিবারে পারিনি।

 পথের দাবীর সংস্পর্শ তুমি ত্যাগ করলে?

 সুমিত্রা মাথা নাড়িয়া জানাইল, হাঁ।

 প্রত্যুত্তরে ডাক্তার শুধু একটুখানি হাসিলেন। তারপরে পকেট হইতে কয়েক খান। টেলিগ্রামের কাগজ বাহির করিয়া সুমিত্রার হাতে দিয়ে বলিলেন, পড়ে দেখ। হীরা সিং কাল রাতে দিয়ে গেছে।

 আইয়ার ঝুঁকিয়া পড়িল, ভারতী প্রজ্বলিত মোমবাতিটি তুলিয়া ধরিল। সুদীর্ঘ টেলিগ্রাম, ভাষা ইংরাজী, অর্থাৎ স্পষ্ট, কিন্তু সুমিত্রার মুখ গম্ভীর হইয়া উঠিল। মিনিটদুই-তিন পরে সে মুখ তুলিয়া কহিল, কোডের সমস্ত কথা আমার মনে নেই। আমাদের সাংহাইয়ের জ্যামেকা ক্লাব এবং ক্রুগার তার পাঠিয়েছে, এছাড়া আর কিছুই বুঝতে পারলাম না।

 ডাক্তার বলিলেন, ক্রুগার ওয়্যার করেছে ক্যানটন থেকে। সাংহাইয়ের

২৮২