পাতা:পথের দাবী - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/২৮৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

শ্রেয়ঃ। শশী এই প্রস্তাব অনুমোদন করিতে পারে নাই, সে যুক্তি-সহযোগে খণ্ডন করিয়া বুঝাইতেছিল যে, এরূপ অভিসন্ধি ভাল নহে, কারণ সন্ন্যাসের মধ্যে আর মজা নাই; বরঞ্চ, বরিশাল কলেজে প্রফেসারির আবেদন যদি মঞ্জুর হয়ত গ্রহণ করাই কর্ত্তব্য।

 অপূর্ব্ব ক্ষুণ্ণ হইল, কিন্তু কথা কহিল না। ভারতী সমস্তই জানিত, তাই সে ইহার জবাব দিয়া বলিল, জীবনে মজা করে বেড়ান ছাড়া কি মানুষের আর বড় উদ্দেশ্য থাকতে পারে না, শশীবাবু? পৃথিবীতে সকলের চোখের দৃষ্টিই এক নয়।

 তাহার কথা বলার ধরণে শশী অপ্রতিভ হইল। ভারতী পুনশ্চ কহিল, ওঁর মনের অবস্থা এখন ভাল নয়, এ সময়ে ওঁর ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনা করা শুধু নিষ্ফল নয়, অবিহিত। তার চেয়ে বরঞ্চ আমাদের নিজেদের—

 আমাদের মনে ছিল না ভারতী!

 শশীর মনে না থাকা কিছু বিচিত্র নয়। ইতিমধ্যে অপূর্ব্বর আরও একটা ব্যাপার ঘটিয়াছে, যাহা ভারতী ব্যতীত অপরে জানিত না। সাংসারিক হিসাবে তাহার ফল ও পরিণাম মাতৃ-বিয়োগের অপেক্ষা বিশেষ কম নহে। জননীর মৃত্যু সংবাদে অপূর্ব্বর দাদা বিনোদবাবু দুঃখ করিয়া তার করিয়াছেন, কিন্তু ইহার অধিক আর কিছু নহে। মা রাগ করিয়া, সম্ভবতঃ অত্যন্ত অপমানিত হইয়াই অবশেষে গঙ্গা-বিহীন ম্লেচ্ছদেশে বর্ম্মায় আপনাকে নির্ব্বাসিত করিয়াছেন বুঝিতে পারিয়া অপূর্ব্ব দুঃখে ক্ষোভে আত্মহারা হইয়া পড়িয়াছিল। যে দুই দিন কলিকাতায় ছিল, বাটীতে খায় নাই, শোয় নাই এবং ফিরিবার মুখে রীতিমত কলহ করিয়াই আসিয়াছিল। তথাপি এত বড় ভয়ানক দুর্ঘটনায় সকলের কনিষ্ঠ হইয়া তাহার নিঃসন্দিগ্ধ ভরসা ছিল, তাহাকে লইয়া যাইবার জন্য কেহ-না-কেহ আসিবেই আসিবে। তেওয়ারী থাকিলে কি হইত বলা যায় না, কিন্তু সে-ও নাই, ছুটি লইয়া দেশে গিয়েছে।

 বাঙালী পুরোহিত এখানেও আছে, আজই সকালে অপূর্ব্ব ভারতীকে ডাকিয়া কহিয়াছিল, সে কলিকাতায় যাইবে না, যেমন করিয়া পারে মাতৃশ্রাদ্ধ এখানেই সম্পন্ন করিবে।

 মাতার আকস্মিক আগমনের হেতু যে ছেলেদের প্রতি দুর্জ্জয় মান-অভিমান,—এ খবর অপূর্ব্ব জানিয়া আসিয়াছিল, শুধু কতখানি যে ক্রীশ্চান-কন্যা ভারতীর কাহিনী সংশ্লিষ্ট ছিল ইহাই জানে নাই। সাংঘাতিক পীড়িতা অচৈতন্য-প্রায় জননীর বলিবার অবকাশ ঘটিল না এবং বিনোদবাবু রাগ করিয়া বলিলেন না।

২৮৫