পাতা:পথের দাবী - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/২৯৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

উদ্যমে চলিতেছে, সহসা রসভঙ্গ করিয়া ফেলিল অপূর্ব্ব। সে কহিল, দিন-দুই পূর্ব্বে খবরের কাগজে একটা সুসংবাদ পড়েছিলাম, ডাক্তার। যদি সত্যি হয় আপনার বিপ্লবের প্রয়াস একেবারে নিরর্থক হয়ে যাবে। ভারত-গভর্ণমেণ্ট তাঁদের শাসনযন্ত্রের আমূল সংস্কার করতে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।

 শশী চক্ষের পলকে রায় দিল, মিছে কথা! ছল!

 ভারতী ঠিক যে বিশ্বাস করিল তাহা নয়, কিন্তু অকৃত্রিম উদ্বেগের সহিত কহিল, ছলনা নাও ত হতে পারে শশীবাবু। যাঁরা নেতা, যাঁরা এই অর্দ্ধশতাব্দকাল ধরে,—না দাদা, তুমি হাসতে পারবে না বলচি!—তাঁদের প্রাণপণ আন্দোলনের কি কোন ফল নেই ভাবো? বিদেশী শাসক হলেও ত তাঁরা মানুষ, ধর্মজ্ঞান এবং নৈতিক বুদ্ধি ফিরে আসা ত একেবারে অসম্ভব নয়!

 শশী তেমনি অসঙ্কোচে অভিমত প্রকাশ করিল, অসম্ভব! মিছে কথা! ধাপ্পাবাজী!

 অপূর্ব্ব কহিল, অনেকে এই সন্দেহই করেন সত্য।

 ভারতী বলিল, সন্দেহ তাঁদের মিথ্যে। ভগবান কি নেই নাকি? এবং পরক্ষণেই অপরিসীম আগ্রহভরে বলিয়া উঠিল, শাসন-পদ্ধতির পরিবর্ত্তন, অত্যাচার-অনাচারের সংস্কার,—এ সব যদি সত্যই হয়, তোমার বিপ্লবের আয়োজন, বিদ্রোহের সৃষ্টি,—তখন ত একেবারেই অর্থহীন হয়ে যাবে দাদা!

 শশী কহিল, নিশ্চয়।

 অপূর্ব্ব কহিল, নিঃসন্দেহ!

 ভারতী তাহার মুখপানে চাহিয়া কহিল, দাদা, তখন এই ভয়ঙ্কর মূর্ত্তি ছেড়ে, আবার শান্ত মূর্ত্তি নেবে বল?

 ডাক্তার দেওয়ালের ঘড়ির দিকে চাহিয়া মনে মনে হিসাব করিয়া কতকটা যেন নিজেকেই কহিলেন, বেশি দেরি নেই আর। তাহার পরে ভারতীকে উদ্দেশ করিয়া অকস্মাৎ অত্যন্ত স্নিগ্ধভাব ধারণ করিয়া বলিলেন, ভারতী, এ আমার ভয়ঙ্কর কিংবা শান্ত মূর্ত্তি আমি আপনিই জানিনে, শুধু জানি এ জীবনে এ রূপ আমার আর পরিবর্ত্তন হবার নয়। আর তোমার নমস্য নেতাদের ভয় নেই দিদি, আজ তাঁদের নিয়ে আমোদ করবার আমার সময়ও নেই, অবস্থাও নয়। বিদেশী শাসনের সংস্কার যে কি, প্রাণপণ আন্দোলনের ফলে কি তারা চান, তার কতটুকু আসল, কতটুকু মেকি,—কি পেলে শশীর ধাপ্পাবাজী হয় না এবং নমস্যগণের কান্না থামে, তার কিছুই আছি জানিনে। বিদেশী গভর্ণমেণ্টের বিরুদ্ধে চোখ রাঙিয়ে যখন তাঁরা চরম বাণী প্রচার করে বলেন, আমরা আর ঘুমিয়ে নেই, আমরা জেগেচি। আমাদের আত্মসম্মানে

২৯২