পাতা:পথের দাবী - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/৩০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

 আমি রে, আমি, দোর খোল, তোর ভয় নেই, বলিয়া অপূর্ব্ব হাসিল। কারণ ইতিমধ্যে ভয়ানক কিছু ঘটে নাই, তেওয়ারী নিরাপদে ঘরের মধ্যেই আছে অনুভব করিয়া তাহার মস্ত যেন একটা ভার নামিয়া গেল।

 ভিতরে প্রবেশ করিয়া রামদাস এ-ঘর ও-ঘর ঘুরিয়া খুশী হইল, কহিল, আমি যা ভয় করেছিলাম তা নয়। আপনার চাকরটি ভাল, সমস্তই একপ্রকার গুছিয়ে ফেলেচে। আসবাবগুলি আমিই পছন্দ করে কিনেছিলাম। আপনার আরও কি-কি দরকার আমাকে জানালেই কিনে পাঠিয়ে দেব—রোজেন সাহেবের হুকুম আছে।

 তেওয়ারী মৃদুম্বরে কহিল, আর আসবাবে কাজ নেই বাবু, ভালয় ভালয় বেরুতে পারলে বাঁচি।

 তাহার মন্তব্যে কেহ মনোযোগ করিল না, কিন্তু অপূর্ব্বর কানে গেল। সে একসমরে আড়ালে জিজ্ঞাসা করিল, আর কিছু হয়েছিল রে?

 না।

 তবে যে ও কথা বললি?

 তেওয়ারী জবাব দিল, বললুম সাধে? সারা দুপুরবেলাটা সাহেব যা ঘোড়দৌড় করে বেড়িয়েচে তাতে মানুষ টিকতে পারে?

 অপূর্ব্ব ভাবিল, ব্যাপারটা সত্যই হয়ত গুরুতর নয়, অন্ততঃ একটা ইতরের ছোটখাটো সমস্ত তুচ্ছ উপদ্রবকেই বড় করিয়া তুলিয়া অনুক্ষণ তেওয়ারীর সহিত একযোগে অশান্তির জের টানিয়া চলাও অত্যন্ত দুঃখের, তাই সে কতকটা তাচ্ছিল্যভরে কহিল, তা সে কি চলবে না তুই বলতে চাস? কাঠের ছাদে একটু বেশ শব্দ হয়ই।

 তেওয়ারী রাগ করিয়া কহিল, এক জায়গায় দাঁড়িয়ে ঘোড়ার মত পা ঠোকা কি চলা?

 অপূর্ব্ব বলিল, তা হলে হয়ত আবার মদ খেয়েছিল

 তেওয়ারী উত্তর দিল, তা হবে। মুখ শুঁকে তার দেখিনি। এই বলিয়া সে বিরক্ত— মুখে রান্নাঘরে চলিয়া গেল, এবং বলিতে বলিতে গেল, তা সে যাই হোক, এ ঘরে বাস করা আর পোষাবে না।

 তেওয়ারীর অভিযোগ অন্যায়ও নয় অপ্রত্যাশিতও নয়, দুর্জ্জনের অসমাপ্ত অত্যাচার যে একটা দিনেই সমাপ্ত হইবে এ ভরসা সে করে নাই, তথাপি অনিশ্চিত আশঙ্কায় মন তাহার অতিশয় বিষণ্ণ হইয়া উঠিল। প্রবাসের প্রথম প্রভাতটা তাহার কুয়াশার মধ্যেই আরম্ভ হইয়াছিল, মাঝে কেবল আফিসের সম্পর্কে একটুখানি আলোর আভাস দেখা দিয়াছিল, কিন্তু দিনান্তের কাছাকাছি মেঘাচ্ছন্ন আকাশ আবার তাহার চোখে পড়িল।

২৬