পাতা:পথের দাবী - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/৩০০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

 ডাক্তার ভারতীয় মুখের দিকে একবার চাহিলেন, কিন্তু দেখিতে পাইলেন না। তখন রহস্যভরে প্রশ্ন করিলেন, চাষাড়ে কবিতা লিখিবে না কবি?

 শশী কহিল, না। তাদের কাব্য তারা লিখতে পারে লিখুক, আমি লিখচিনে। আপনার সে-কথা আমি অনেক ভেবে দেখেচি। এবং এ উপদেশও কখনো ভুলব না যে, আইডিয়ার জন্য সর্ব্বস্ব বিসর্জ্জন দিতে পারে শুধু শিক্ষিত ভদ্র সন্তান, অশিক্ষিত কৃষকে পারে না। আমি হব তাদেরই কবি।—

 ডাক্তার বলিলেন, তাই হোয়ো! কিন্তু এইটেই শেষ কথা নয়, কবি, মানবের গতি এইখানেই নিশ্চল হয় থাকবে না। কৃষকের দিনও একদিন আসবে, যখন তাদের হাতেই জাতির সকল কল্যাণ-অকল্যাণের ভার সমর্পণ করতে হবে।

 শশী বলিল, আসুক সেদিন। তখন, স্বচ্ছন্দ, শান্ত চিত্তে সব দায়িত্ব তাদের হাতে তুলে দিয়েই আমরা ছুটি নেব। কিন্তু আজ না। আজ আত্ম-বলিদানের গুরুভার তারা বইতে পারবে না।

 ডাক্তার উঠিয়া আসিয়া তাহার কাঁধের উপর ডান হাত রাখিয়া চুপ করিয়া রহিলেন, কিছু বলিলেন না।

 অপূর্ব্ব এতক্ষণ নিঃশব্দে স্থির হইয়া শুনিতেছিল, ইহাদের কোন আলোচনাতেই কথা কহে নাই। কিন্তু শশীর শেষের দিকের মন্তব্য তাহার ভারি খারাপ ঠেকিল। যে কৃষকের মঙ্গলোদ্দেশে আত্মনিয়োগের সংকল্প সে স্থির করিয়াছে, তাহাদের বিরুদ্ধে এই সকল অভিমতে ক্ষুব্ধ ও অসন্তুষ্ট হইয়া বলিয়া উঠিল, মদ খাওয়া খারাপ, বেশ উনি ছেড়ে দিন, কাব্য-চর্চ্চা ভালো তাই করুন; কিন্তু কৃষি-প্রধান ভারতবর্ষের কৃষককূল কি এমনি তুচ্ছ, এতই অবহেলার বস্তু? এবং এরাই যদি বড় হয়ে না ওঠে, আপনাদের বিপ্লবই বা করবে কে? এবং করবেই বা কেন? আর পলিটিক্স! যথার্থ বলচি ডাক্তার, কৃষকের কল্যাণে সন্ন্যাস-ব্রত যদি আমি না নিতাম, আজ স্বদেশের রাজনীতিই হোতো আমার জীবনের একমাত্র কর্ত্তব্য।

 ডাক্তার ক্ষণকাল তাহার মুখের প্রতি চাহিয়া রহিলেন। সহসা প্রসন্ন স্নিগ্ধাজ্জ্বল হাস্যে তাহার মুখ প্রদীপ্ত হইয়া উঠিল। কহিলেন, আমি কায়মনে প্রার্থনা করি তোমার সদুদ্দেশ্য যেন সফল হয়। রাজনৈতিক ক্ষেত্রও তাচ্ছিল্যের সামগ্রী নয়। দেশের ও দশের কল্যাণে বৈরাগ্যই যদি গ্রহণ করে থাকো, কারো সঙ্গেই তোমার বিরোধ বাধবে না। আমি শুধু এই কথাই বলি, অপূর্ব্ববাবু, সকলে কিন্তু সকল কাজের যোগ্য হয় না!

 অপূর্ব্ব স্বীকার করিয়া বলিল, আমার চেয়ে এ শিক্ষা আর কার বেশি হয়েছে ডাক্তার, আপনি দয়া না করলে বহুদিন পূর্ব্বেই ত এই ভ্রমের চরম দণ্ড আমার

২৯৬