পাতা:পথের দাবী - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/৩০৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

ভারতী! আর বিদেশ? কিন্তু ভগবান এইটুকু দয়া করেচেন, মানুষের মর্জ্জিমত ছোট বড় প্রাচীরের বেড়া তুলে তাঁর পৃথিবীকে আর সহস্র কারাকক্ষে পৃথক করে রাখবার তিনি জো রাখেননি। উত্তর থেকে দক্ষিণে, পূর্ব্ব থেকে পশ্চিমে যতদূর দৃষ্টি যায় বিধাতার রাজপথ একেবারে উন্মুক্ত হয়ে গেছে। একে রুদ্ধ করে রাখবার চক্রান্ত মানুষের হাতের নাগাল ডিঙ্গিয়ে গেছে। এখন এক প্রান্তের অগ্নুৎপাত অপর প্রান্তে স্ফুলিঙ্গ উড়িয়ে আনবেই আনবে ভারতী, সে তাণ্ডব দেশ-বিদেশের গণ্ডী মানবে না!

 কিন্তু এদিকে যে রুদ্রের সত্যকার তাণ্ডব ঘরের বাহিরে তখন কি উন্মাদ মূর্ত্তিই ধারণ করিয়াছিল, ভিতর হইতে তাহা কেহই উপলব্ধি করে নাই। বিদ্যুতে, ঝঞ্ঝায়, প্লাবনে ও বজ্রাঘাতে সে যেন একেবারে প্রলয় শুরু হইয়া গিয়াছিল, এবং ডাক্তার অর্গল মুক্ত করিতেই এক ঝলক সুতীক্ষ্ণ বৃষ্টির ছাট ভিতরে ঢুকিয়া সকলকে ভিজাইয়া আলো নিবাইয়া সমস্ত ওলট-পালট করিয়া ঘর ও বাহির চক্ষের পলকে অন্ধকারে একাকার করিয়া দিল।

 ডাক্তার ডাকিলেন, সরদারজী!

 বাহির হইতে সাড়া আসিল, ইয়েস ডক্টর, রেডি।

 সকলে চমকিত হইল। এই দুঃসহ বায়ু ও মুষলধারে বৃষ্টি মাথায় পাতিয়া কেহ যে এই সূচীভেদ্য আঁধারে দাঁড়াইয়া নিশ্চল নিঃশব্দ প্রহরায় নিযুক্ত থাকিতে পারে এ কথা সহসা যেন কেহ ভাবিতেই পারিল না।

 ডাক্তার রহস্যভরে কহিলেন, তাহলে আমি এখন! এই বলিয়া বাহিরে পা বাড়াইবার সঙ্গে সঙ্গেই অপূর্ব্ব ব্যাকুল কণ্ঠে বলিয়া উঠিল, একদিন যে আমি প্রাণ পেয়েছিলাম একথা চিরদিন মনে রাখবো ডাক্তার।

 অন্ধকার হইতে জবাব আসিল, তুচ্ছ পাওয়ার ব্যাপারটাকেই কেবল বড় করে দেখলে, অপূর্ব্ববাবু, যে দিলে তাকে মনে রাখলে না?

 অপূর্ব্ব চীৎকার করিয়া কহিল, মনে? এ-জীবনে ভুলব না। এ ঋণ মরণ পর্য্যন্ত আমি—

 দূরে আঁধারের মধ্য হইতে প্রত্যুত্তর আসিল, তাই যেন হয়। প্রার্থনা করি, সত্যকার দাতাকে যেন একদিন তুমি চিনতে পারো অপূর্ব্ববাবু! সেদিন সব্যসাচীর ঋণ—

 কথার শেষটা আর শুনা গেল না, অস্ফুটধ্বনি বায়ুবেগে শূন্যে ভাসিয়া গেল। তাহার পরে ক্ষণকালের জন্য যেন কাহাহারও সংজ্ঞা রহিল না। অচেতন জড়মূর্ত্তির ন্যায় কয়েক মুহূর্ত্ত নিশ্চল থাকিয়া ভারতী অকস্মাৎ চকিত হইয়া উঠিল এবং দ্রুতবেগে উপরে উঠিয়া আসিতেই সবাই তাহার পিছনে ছুটিয়া আসিল। সে ক্ষিপ্রহস্তে

২৯৯