পাতা:পথের দাবী - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/৩৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

বলিয়া চিনিতে পারে নাই। তাহার কৈফিয়ৎ, সঙ্গ ও সহানুভুতির দায় এড়াইয়া অপূর্ব্ব স্টেশনে খোঁজ করিয়া সোজা স্টেশন মাস্টারের ঘরে গিয়া প্রবেশ করিল। তিনিও সাহেব,—কাজ করিতেছিলেন, মুখ তুলিয়া চাহিলেন। অপূর্ব্ব জুতার দাগ দেখাইয়া ঘটনা বিবৃত করিল। তিনি বিরক্তি ও অবজ্ঞা ভরে মিনিট খানেক শুনিয়া কহিলেন, ইউরোপীয়ানদের বেঞ্চে তুমি বসিতে গেলে কেন?

 অপূর্ব্ব উত্তেজনার সহিত কহিল, আমি জানতাম না—

 তোমার জানা উচিত ছিল।

 কিন্তু তাই বলে খামকা গায়ে হাত দেবে?

 সাহেব দ্বারের দিকে হাত বাড়াইয়া কহিলেন— গো—গো—গো—চাপ্‌রাশি ইস্‌কো বহর্ কর্ দেও—বলিয়া কাজে মন ছিলেন।

 তাহার পরে অপূর্ব্ব কি করিয়া যে বাসায় আসিল সে ঠিক জানে না। ঘণ্টা দুই পূর্ব্বে রামদাসের সহিত এই পথে একত্রে আসিবার কালে সব চেয়ে যে দুর্ভাবনা তাহার মনে বেশী বাজিতেছিল সে তাহার অকারণ মধ্যস্থতা। একে ত উৎপাত ও অশান্তির মাত্রা তাহাতে কমিবে না, বরঞ্চ বাড়িবে, তাছাড়া, সে ক্রীশ্চান মেয়েটির যত অপরাধই কেননা থাক, কেবলমাত্র মেয়েমানুষ বলিয়াই ত পুরুষের মুখ হইতে ওরূপ কঠিন কথা বাহির হওয়া সঙ্গত হয় নাই।—তাহাতে আবার সে তখন একাকী ছিল। তাহার শিক্ষিত ভদ্র অন্তঃকরণ রামদাসের কথায় ক্ষুণ্ণই হইয়াছিল,—কিন্তু এখন ফিরিবার পথে তাহার সে ক্ষোভ কোথায় যে বিলুপ্ত হইয়া গিয়াছিল তাহার ঠিকানা ছিল না। তাহাকে মনে যখন হইল, তখন মেয়েমানুষ বলিয়া আর মনে হইল না—মনে হইল ক্রীশ্চানের মেয়ে, সাহেবের মেয়ে বলিয়া,—যে ছোঁড়াগুলো তাহাকে এইমাত্র অকারণ অপমানের একশেষ করিয়াছে—যাহাদের কুশিক্ষা ইতরতা ও বর্ব্বরতার অবধি নাই—তাহাদেরই ভগিনী বলিয়া—যে-সাহেবটা একান্ত অবিচারে তাহাকে ঘর হইতে বাহির করিয়া দিল—মানুষের সামান্য অধিকারটুকুও দিল না—তাহারই পরম জাত্মীয় বলিয়া।

 তেওয়ারী আসিয়া কহিল, ছোটবাবু, আপনার খাবার তৈরী হয়েছে। অপূর্ব্ব কহিল, যাই—

 মিনিট দশ পনেরো পরে সে পুনরায় আসিয়া জানাইল, খাবার যে সব জুড়িয়ে গেল বাবু—

 অপূর্ব্ব রাগ করিয়া বলিল, কেন বিরক্ত করিস তেওয়ারী, আমি খাব না—আমার ক্ষিদে নেই।

 চোখে তাহার ঘুম আসিল না, রাত্রি যত বাড়িতে লাগিল, সমস্ত বিছানাটা

৩০