পাতা:পথের দাবী - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/৪০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

এ সম্বন্ধে কেহই কাহাকে কোন কথা কহিত না। নিরুপদ্রবেই দিন কাটিতেছিল— এই ভাল। সপ্তাহখানেক পরে একদিন আফিস হইতে ফিরিবার পরে তেওয়ারী প্রফুল্লমুখে মনের আনন্দ যথাসাধ্য সংযত করিয়া কহিল, আর শুনেচেন ছোটবাবু?

 অপূর্ব্ব কহিল, কি?

 সাহেব যে ঠ্যাঙ-ভেঙে একেবারে হাসপাতালে। বাঁচে কি না বাঁচে! আজ ছ’দিন হ’ল—ঠিক তার পরের দিনই!

 অপূর্ব্ব বিস্মিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিল,—তুই কি করে জানলি?

 তেওয়ারী বলিল, বাড়িয়ালার সরকার আমাদের জেলায় লোক কিনা, তার সঙ্গে আজ পরিচয় হ’ল। ভাড়া আদায় করতে এসেছিল। কে বা ভাড়া দেবে,—মদ খেয়ে মারামারি করে জেটি থেকে নীচে পড়ে সাহেব ত গিয়ে হাসপাতালে শুয়ে আছেন।

 তা হবে, বলিয়া অপূর্ব্ব কাপড় ছাড়িতে নিজের ঘরে চলিয়া গেল। কলিকাতা ত্যাগ করার পরে এই প্রথম তেওয়ারীর মন সত্যকার প্রসন্নতায় ভরিয়া উঠিয়াছে। তাহার একান্ত অভিলাষ ছিল এই লইয়া সে আজ বেশ একটুখানি আলোচনা করে, কিন্তু মনিব তাহাতে উৎসাহ দিলেন না। নাই দিন, তবুও সে বাহির হইতে নানা উপায়ে শুনাইয়া দিল যে এরূপ একদিন ঘটিবেই তাহা সে জানিত। তেওয়ারী সন্ধ্যা আহ্নিক শিখিতে পারে নাই, কিন্তু গায়ত্রীটা তাহার মুখস্ত হইয়াছিল, সেই গায়ত্রী সে জরিমানার দিন হইতে সকাল-সন্ধ্যা একশত আট করিয়া দুইশত ষোল বার প্রত্যহ জপ করিয়াছে। সাহেবের পা ভাঙার যথার্থ হেতু কি, ছেলেমানুষ মনিব তাহা অনুধাবন করিল কি-না সন্দেহ, কিন্তু এই মন্ত্রের অসাধারণ শক্তির প্রতি তেওয়ারীর বিশ্বাস সহস্রগুণে বাড়িয়া গেল। ম্লেচ্ছ হইয়া ব্রাহ্মণের মাথার উপরে যে ঘোড়ার মত পা ঠুকিয়াছে পা তাহার ভাঙ্গিবে না ত কি!

 পরদিন সকালে তাহার আফিসের আরদালির কাছে খবর পাইয়া অপূর্ব্ব তেওয়ারীকে ডাকিয়া কহিল, একটা বাসার সন্ধান পাওয়া গেছে তেওয়ারী, গিয়ে দেখে আয় দেখি পোষাবে কি না।

 তেওয়ারী একটু হাসিয়া কহিল, আর বোধ হয় দরকার হবে না বাবু, সে-সব আমি ঠিক করে নিয়েচি। আসচে পয়লা তারিখে যারা যাবার তারাই যাবে। বাসা বদলানো ত সোজা ঝঞ্ঝাট নয় ছোটবাবু!

 ঝঞ্ঝাট যে সোজা নয় অপূর্ব্ব নিজেও তাহা জানিত সাহেবের অবর্ত্তমানে উৎপাত বন্ধ হইয়াছে, তাঁহার প্রত্যাগমনের পরেও যে তাহা বজায় থাকিবে এ ভরসা তাহার ছিল না। বাসা তাহাকে বদল করিতেই হইবে, কিন্তু আফিস যাইবার

৩৬