পাতা:পথের দাবী - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/৪৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

তাহার সুমিষ্ট সলজ্জ ব্যবহারে, বিশেষ করিয়া তাহার সেই সকরুণ সহানুভুতিতে অপূর্ব্বর মনের মধ্যে যে একটুখানি মোহের মত জন্মিয়াছিল, তাহার পরবর্ত্তী আচরণে সে ভাব আর তাহার ছিল না। ভারতীর এই চুরি গোপন করিবার আগ্রহ এখন হঠাৎ কেমন তাহার ভারি খারাপ লাগিল। এই সকল অযাচিত সাহায্যকেও আর যেন সে প্রসন্নচিত্তে গ্রহণ করিতে পারিল না এবং কি একপ্রকায় অজানা শঠতায় সংশয়ে সমস্ত অন্তঃকরণ তাহার দেখিতে দেখিতে কালো হইয়া উঠিল। সে দিনের সেই সভয়ে, সঙ্কোচে, গোপনে ফল-মূল দিতে আসা, পরক্ষণেই আবার ঘরে গিয়া সমস্ত ঘটনা বিকৃত করিয়া মিথ্যা করিয়া বলা, তারপরে সেই আদালতে সাক্ষ্য দেওয়া,—নিমিষে সমস্ত ইতিহাস মনের মধ্যে তড়িত রেখায় খেলিয়া গিয়া মুখ তাহার গম্ভীর ও কণ্ঠস্বর ভারী হইয়া উঠিল। এ সমস্তই অভিনয়, সমস্তই ছলনা! তাহার মুখের এই আকস্মিক পরিবর্ত্তন ভারতী লক্ষ্য করিল, কিন্তু কারণ বুঝিতে পারিল না, বলিল, আমার কথার জবাব দিলেন না যে বড়?

 অপূর্ব্ব কহিল, এর আর জবাব কি? চোরকে প্রশ্রয় দেওয়া চলে না,—পুলিশে একটা খবর দিতেই হবে।

 ভারতী ভয় পাইয়া কহিল, সে কি কথা! চোরও ধরা পড়বে না, টাকাও আদায় হবে না; মাঝে থেকে আমাকে নিয়ে যে টানাটানি করবে। আমি দেখেচি, তালাবন্ধ করেচি, সমস্ত গুছিয়ে তুলে রেখেচি,—আমি যে বিপদে পড়ে যাবো।

 অপূর্ব্ব কহিল, যা ঘটেচে তাই বলবেন।

 ভারতী ব্যাকুল হইয়া জবাব দিল, বললে কি হবে? এই সেদিন আপনার সঙ্গে তুমূল কাণ্ড হয়ে গেল, মুখ দেখা-দেখি নেই, কথাবার্ত্তা বন্ধ, হঠাৎ আপনার জন্যে আমার এত মাথাব্যথা পুলিশ বিশ্বাস করবে কেন?

 অপূর্ব্বর মন সন্দেহে অধিকতর কঠোর হইয়া উঠিল, কহিল, আপনার আগাগোড়া মিছে কথা তারা বিশ্বাস করতে পারলে আর সত্য কথা পারবে না? টাকা সামান্যই গেছে, কিন্তু চোরকে আমি শাস্তি না দিয়ে ছাড়ব না।

 তাহার মুখের পানে ভারতী হতবুদ্ধির ন্যায় চাহিয়া রহিল; কহিল, আপনি বলেন কি অপূর্ব্ববাবু? বাবা ভাল লোক নন, তিনি অকারণে আপনার প্রতি অত্যন্ত অন্যায় করেচেন, আমি যে সাহায্য করেচি তাও আমি জানি, কিন্তু তাই বলে ঘর ভেঙে বাক্স ভেঙে আপনার টাকা চুরি করবো আমি? একথা আপনি ভাবতে পারলেন, কিন্তু আমি ত পারিনি। এ দুর্নাম রটলে আমি বাঁচব কি করে! বলিতে বলিতে তাহার ওষ্ঠাধর ফুলিয়া কাঁপিয়া উঠিল এবং দাঁত দিয়া জোর করিয়া ঠোঁট চাপিতে চাপিতে সে যেন ঝড়ের বেগে বাহির হইয়া গেল।

৪২