পাতা:পথের দাবী - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/৪৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

জানি, শুধু এ দেশে এসে কোন্ পথে যে তিনি পা বাড়াবেন সেইটি কেবল আমরা জানিনে। কিন্তু দেখো বাবা, এসব কথা যেন কোথাও প্রকাশ ক’রো না। তাহলে এই বৃদ্ধ বয়সে সাতাশ বছরের পেন্সনটি ত মারা যাবেই, হয়ত বা কিছু উপরি পাওনাও ভাগ্যে ঘটতে পারে।

 অপূর্ব্ব উৎসাহ ও উত্তেজনায় চঞ্চল হইয়া কহিল, এতদিন কোথায় এবং কি করছিলেন ইনি? সব্যসাচী নাম ত কখন শুনেচি মনে হচ্চে না!

 নিমাইবাবু সহাস্যে কহিলেন, ওরে বাবা, এই সব বড় লোকদের কি আর কেবল একটা নামে কাজ চলে? অর্জ্জুনের মত দেশে দেশে কত নামই এর প্রচলিত আছে। সেকালে হয়ত শুনেও থাকবে এখন চিনতে পারচো না। আর কি যে ইতিমধ্যে করছিলেন সম্যক্ ওয়াকিফহাল নই। রাজ-শত্রুরা ত তাঁদের সমস্ত কাজকর্ম্ম ঢাকপিটে করতে পছন্দ করেন না, তবে পুণায় এক দফা তিন মাস এবং সিঙ্গাপুরে আর এক দফা তিন বছর জেল খেটেচেন জানি। ছেলেটি দশ-বারোটা ভাষা এমন বলতে পারে যে বিদেশী লোকের পক্ষে চেনা ভার ইনি কোথাকার। জারমেনির জেনা না কোথায় ডাক্তারি পাশ করেচে, ফ্রান্সে ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করেচে, বিলেতে আইন পাশ করেচে, আমেরিকায় কি পাশ করেচে জানিনে, তবে সেখানে ছিল যখন, তখন কিছু একটা করেই থাকবে,—এসব বোধ করি এর তাসপাশা খেলার সামিল,—রিক্রিয়েশান, কিন্তু কিছুই কোন কাজে এলো না বাবা এর সর্ব্বাঙ্গের শিরা দিয়ে ভগবান এমনি আগুন জ্বেলে দিয়েচেন যে ওকে জেলেই দাও আর শূলেই দাও ঐ যে বললুম পঞ্চভূত ছাড়া আর আমাদের শান্তি স্বস্তি নেই! এদের না আছে দয়া-মায়া, না আছে ধর্ম্ম-কর্ম্ম, না আছে কোন ঘর-দোর,—বাপরে বাপ! আমরাও ত এদেশেরই মানুষ, কিন্তু এ ছেলে যে কোত্থেকে এসে বাঙলা মুলুকে জন্মালো তা ভেবেই পাওয়া যায় না!

 অপূর্ব্ব সহসা কথা বলিতে পারিল না,—শিরার মধ্য দিয়া তাহারও যেন আগুন ছুটিতে লাগিল। কিছুক্ষণ নিঃশষে চলার পরে আস্তে আস্তে কহিল, এঁকে কি আজ আপনি অ্যারেস্ট করবেন?

 নিমাইবাবু হাসিয়া বলিলেন, আগে ত পাই!

 অপূর্ব্ব কহিল, ধরুন, পেলেন।

 না বাবা, অত সহজ বস্তু নয়। আমার নিশ্চয় বিশ্বাস সে শেষ মুহূর্ত্তে আর কোন পথ দিয়ে আর কোথাও সরে গেছে।

 যায় যদি তিনি এসেই পড়েন তাহলে?

 নিমাইবাবু একটু চিন্তা করিয়া কহিলেন, তাঁকে চোখে চোখে রাখবার হুকুম

৪৫