পাতা:পথের দাবী - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/৫১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

বলে রাখি অপুর্ব্ব। এখন আর তুমি ছেলেমানুষ নও, বাবাও বেঁচে নেই,—ভবিষ্যৎ ভেবে কাজ করার দায়িত্ব এখন একা তোমারই।

 অপূর্ব্ব হাসিয়া কহিল, আলাপ-পরিচয়ের সুযোগই কি আপনারা কাউকে কখনো দেন কাকাবাবু? দোষ করেননি, কোন অভিযোগও নেই, তবুও তাঁকে ফাঁদে ফেলবার চেষ্টায় এতদূরে ছুটে এসেছেন।

 ইহার উত্তরে নিমাইবাবু শুধু একটু মুচকিয়া হাসিলেন। তাহায় অর্থ অতীব গভীর। মুখে কহিলেন, কর্ত্তব্য।

 কর্ত্তব্য! এই ছোট্ট একটি কথার আড়ালে পৃথিবীর কত ভাল এবং কত মন্দই না সঞ্চিত হইয়া আছে। এই মনে করিয়া অপূর্ব্ব আর কোন প্রশ্ন করিল না। উভয়ে জেটিতে যখন প্রবেশ করিলেন তখন সেইমাত্র ইরাবতী নদীর প্রকাণ্ড স্টীমার তীরে ভিড়িবার চেষ্টা করিতেছিল। পাঁচ-সাতজন পুলিশ-কর্ম্মচারী সাদা পোষাকে পূর্ব্ব হইতেই দাঁড়াইয়াছিল, নিমাইবাবুর প্রতি তাহাদের একপ্রকার চোখের ইঙ্গিত লক্ষ্য করিয়া অপূর্ব্ব তাহাদের স্বরূপ চিনিতে পারিল। ইহারা সকলেই ভারতবর্ষীয়—ভারতের কল্যাণের নিমিত্ত সুদূর বর্ম্মায় বিদ্রোহী শিকারে বাহির হইয়াছেন। সেই শিকারের বস্তু তাঁহাদের করতলগতপ্রায়। সফলতার আনন্দ ও উত্তেজনার প্রচ্ছন্ন দীপ্তি তাঁহাদের মুখে-চোখে প্রকাশ পাইয়াছে অপূর্ব্ব স্পষ্ট দেখিতে পাইল। লজ্জায় ও দুঃখে সে মুখ ফিরাইয়া দাঁড়াইতেই অকস্মাৎ এক মুহূর্ত্তে তাহার সমস্ত ব্যথিত চিত্র গিয়া যেন কোন এক অদৃষ্টপূর্ব্ব অপরিচিত দুর্ভাগার পদপ্রান্তে উপুড় হইয়া পড়িয়া তাহার পথরোধ করিয়া দাঁড়াইল। জাহাজের খালাসীরা তখন জেটির উপরে দড়ি ছুঁড়িয়া ফেলিতেছিল, কত লোক রেলিং ধরিয়া তাহাই উদগ্রীব হইয়া দেখিতেছে,—ডেকের উপরে ব্যগ্রতা, কলরব ও ছুটাছুটির অবধি নাই, হয়ত ইহাদেরই মাঝ খানে দাঁড়াইয়া একজন এমনি উৎসুক-চক্ষে তীরের প্রতীক্ষা করিতেছে, কিন্তু অপূর্ব্বর চোখে সমস্ত দৃশ্যই চোখের জলে একেবারে ঝাপ্‌সা একাকার হইয়া গেল। উপরে, নীচে, জলে, স্থলে, এত নর-নারী দাঁড়াইয়া, কাহারও কোন শঙ্কা নাই, কোন অপরাধ নাই, শুধু যে লোক তাহার তরুণ হৃদয়ের সকল সুখ, সকল স্বার্থ, সকল আশা স্বেচ্ছার বিসর্জ্জন দিয়াছে, কারাগার ও মৃত্যুর পথ কি কেবল তাহারই জন্য হাঁ করিয়া রহিয়াছে। জাহাজ জেটির গায়ে আসিয়া ভিড়িল, কাঠের সিঁড়ি নীচে আসিয়া লাগিল, নিমাইবাবু তাঁহার দলবল লইয়া পথের দু’ধারে সারি দিয়া দাঁড়াইলেন, কিন্তু অপূর্ব্ব নড়িল না। সে সেখানে নিশ্চল পাথরের মূর্ত্তির মত দাঁড়াইয়া একান্তমনে বলিতে লাগিল, মুহূর্ত্ত পরে তোমার হাতে শৃঙ্খল পড়িবে, কৌতূহলী নর-নারী তোমার লাঞ্ছনা ও অপমান চোখ মেলিয়া দেখিবে, তাহারা

৪৭