পাতা:পথের দাবী - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/৬১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

 ইহার পরে আর অপূর্ব্ব প্রত্যুত্তর করে নাই। কিন্তু শেষের দিকে ঘণ্টা তিন চারেক নিরুপদ্রবে কাটার পরে সকালে যখন তাহার ঘুম ভাঙ্গিল, তখন বিগত রাত্রির গ্লানির কথা আর তাহার মনে ছিল না। একটা বড় পাহাড়ের অনতিদূর দিয়া গাড়ি মন্থর গতিতে চলিয়াছিল, খুব সম্ভব চড়াইয়ের পথ। এইখানে জানালার বাহিরে মুখ বাড়াইয়া সে অকস্মাৎ বিস্ময়ে একেবারে স্তব্ধ হইয়া রহিল। চক্ষের পলকে বুঝিল, পৃথিবীর এতবড় সৌন্দর্য্য-সম্পদ সে আর কখনও দেখে নাই। গিরিশ্রেণী অর্দ্ধবৃত্তাকারে বিস্তৃত হইয়া যেন পিছন ও সুমুখের পথ রোধ করিয়া দাঁড়াইয়াছে, তাহার বিরাট দেহ ব্যাপিয়া কি গভীর বন এবং গগনস্পর্শী কি বিপুলকায় বৃক্ষরাজীই না তাহার সুবিস্তীর্ণ পাদমূল ঘেরিয়া সারি দিয়া দাঁড়াইয়াছে! বোধহয় সবেমাত্র সূর্য্যোদয় হইয়াছে, বামদিকের শিখর ডিঙাইয়া রথ তাঁহার আকাশে এখনও দেখা দেয় নাই, কিন্তু অগ্রবর্ত্তী কিরণচ্ছটায় উপরের নীল অরণ্যে সোনা মাখাইয়া সেই তাঁহার আসার সংবাদ দিকে দিকে প্রচারিত হইতে আর বাকী নাই। খাদের মধ্যে শিখরনিঃসৃত জলের ধারা বহিয়াছে, বনের ছায়ার নীচে তাহার শান্ত প্রবাহ অশ্রু-রেখার মতই সকরুণ হইয়া উঠিয়াছে। অপূর্ব্ব মুগ্ধ হইয়া গেল। একি আশ্চর্য্য সুন্দর দেশ! এখানে যাহারা যুগ-যুগান্তর ধরিয়া বাসা বাঁধিতে পাইয়াছে তাহাদের সৌভাগ্যের কি সীমা আছে? কিন্তু কেবলমাত্র সীমা নাই বলিয়া, শুধু একটা অনির্দ্দিষ্ট আনন্দের আভাসমাত্র লইয়াই মানবের হৃদয় পূর্ণ তৃপ্তি মানিতে চাহে না,—তাই সে ইহাকে মূর্ত্তি দিয়া, রূপ দিয়া মনে মনে সহস্রবিধ রসে ও রঙে পল্লবিত করিয়া ক্রোশের পর ক্রোশ অতিক্রম করিয়া চলিতে লাগিল। এমনি করিয়া তাহার ভাবুক চিত্ত যখন অন্তরে-বাহিরে আচ্ছন্ন অভিভূত হইয়া আসিতেছিল, তখন হঠাৎ যেন কঠিন ধাক্কায় চমকিয়া দেখিল তাহার কল্পনার রথচক্র মেদিনী গ্রাস করিতেছে। রামদাস তলওয়ারকরের কথাগুলো মনে পড়িল। আসিয়া পর্য্যন্ত এই ব্রহ্মদেশের অনেক গুপ্ত ও ব্যক্ত কাহিনী সে সংগ্রহ করিতেছিল। সেই প্রসঙ্গে একদিন সে বলিয়াছিল, বাবুজী, শুধু কেবল শোভা সৌন্দর্য্যই নয় প্রকৃতি-মাতার দেওয়া এত সম্পদও কম দেশে আছে। ইহার বন ও অরণ্য অপরিমেয় মাটির মধ্যে ইহার অফুরন্ত তেলের প্রস্রবণ, ইহার মহামূল্য রত্নখনির মূল্য নিরূপিত হয় না, আর ওই যে আকাশচুম্বি মহাদ্রুমের সারি, জগতে ইহার তুলনা কোথায়? সে বেশিদিনের কথা নয়, সংবাদ পাইয়া একদিন ইংরাজ বণিকের লুব্ধদৃষ্টি ইহারই প্রতি একেবারে একান্ত হইয়া পড়িল। তাহার অনিবার্য্য পরিণাম অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত এবং সোজা। বিবাদ বাধিল, মানোয়ারি জাহাজ আসিল, বন্দুক-কামান আসিল, সৈন্যসামন্ত আসিল, লড়াই বাধিল, যুদ্ধে হারিয়া দুর্ব্বল অক্ষম রাজা নির্ব্বাসিত হইলেন,

৫৭