পাতা:পথের দাবী - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/৬২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

এবং তাঁহার রাণীদের গায়ের গহনা বেচিয়া লড়াইয়ের খরচ আদায় হইল। অতঃপর দেশের ও দশের কল্যাণে, মানবতার কল্যাণে, সভ্যতা ও ন্যায়-ধর্ম্মের কল্যাণে ইংরাজ রাজশক্তি বিজিত দেশের শাসনভার গ্রহণ করিয়া তাহাদের অশেষবিধ ভাল করিতে কায়মনে লাগিয়া গেলেন। তাই ত আজ তথায় সতর্কতার অবধি নাই, তাই ত সেই বিজিত দেশের পুলিশ কর্ম্মচারী তাহারই মত আর এক পরাধীন দেশের নিরীহ ব্যক্তিকে বারংবার ঘুম ভাঙাইয়া নিঃসংকোচে বলিতে পারিল, তুমি ত সাহেব নও যে, তোমাকে অপমান করিতে আমায় বাধবে? অপূর্ব্ব মনে মনে কহিল, বটেই ত। বটেই ত! ইহার অধিক আমাকে সে কি দিবে? ইহার বড় আমিই বা কোন্ মুখে তাহার কাছে দাবী করিব?

 অরণ্যশিরে প্রভাত-সূর্য্যের কনক আভা তখনও রঙ হারায় নাই, কিন্তু তাহার চোখে অত্যন্ত ম্লান ও ক্লান্তিহীন ঠেকিল— সমুন্নত পর্ব্বতমালা তাহার কাছে সামান্য এবং বৃক্ষশ্রেণীর যে বিপুলতা দেখিরা সে ক্ষণেক পূর্ব্বে বিস্ময়-মুগ্ধ হইয়াছিল, তাহারাই তাহার দৃষ্টিতে সাধারণ ও নিতান্ত বিষেত্ববর্জ্জিত বলিয়া বোধ হইল। তাহার নদীমাতৃক সমতল শস্যশ্যামল বঙ্গভূমিকে মনে পড়িয়া দুই চক্ষু অশ্রুপূর্ণ হইয়া উঠিল— প্রবাসী পীড়িত চিত্ত তাহার বুকের মধ্যে আর্ত্তনাদ করিয়া যেন বারবার করিয়া বলিতে লাগিল, ওরে দুর্ভাগা দেশের শক্তিহীন নর-নারী। ওই অশেষ ঐশ্বর্য্যময়ী জন্মভূমির প্রতি তোদের অধিকার কিসের? যে ভার, যে গৌরব তোরা বহিতে পারিবি না, তাহার প্রতি এই ব্যর্থ লোভ তোদের কিসের জন্য? স্বাধীনতার জন্মগত অধিকার আছে কেবল মনুষ্যত্বের, শুধু মানুষ বলিয়াই থাকে না; এ কথা আজ কে অস্বীকার করিবে? ভগবানও যে ইহা হরণ করিতে পারেন না! তোদের ওই সব ক্ষুদ্র, তুচ্ছ, পঙ্গু হাত-পাগুলোকেই কি তোরা মানুষ বলিয়া স্থির করিয়া বলিয়া আছিস্? ভুল ভুল; ইহার বড় আত্মঘাতী ভুল ত আর হইতেই পারে না! এমনি কত কি যে আপনাকে আপনি বলিতে বলিতে তাহার সময় কাটিতে লাগিল তাহার হিসাব ছিল না, অকস্মাৎ, ট্রেনের গতি মন্দীভূত হওয়ায় তাহার চেতনা হইল। তাড়াতাড়ি চোখ মুছিয়া বাহিরে চাহিয়া দেখিল গাড়ি স্টেশনের মধ্যে প্রবেশ করিতেছে।

৫৮