পাতা:পথের দাবী - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/৬৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

 যে দ্বিতল ঘরটিতে সে বাসা লইয়াছে তাহার নীচের তলায় একটি ব্রহ্মদেশীয় ভদ্রলোক সপরিবারে বাস করিতেছিলেন। সকালে অফিসে যাইবার পূর্ব্বে তাঁহার সংসারে এক বিষম অনর্থ ঘটে। তাঁহার চার কন্যা, সকলেই বিবাহিতা। কি একটা উৎসব উপলক্ষ্যে জামাতারা সকলেই আজ উপস্থিত হইয়া ছিলেন। ভোজের সমর সম্ভ্রম ও ইজ্জত লইয়া প্রথমে মেয়েদের মধ্যে এবং অনতিকাল পরেই বাবাজীবনদের মধ্যে লাঠালাঠি রক্তারক্তি বাঁধিয়া যায়, অপূর্ব্ব খবর লইতে গিয়া হতবুদ্ধি হইয়া শুনিল যে, ইহাদের একজন মাদ্রাজের চুলিয়া মুসলমান, একজন চট্টগ্রামের বাঙালী-পর্ত্তুগীজ, একজন এ্যাংলো-ইণ্ডিয়ান সাহেব এবং ছোট জামাতাটি চীনা, কয়েক পুরুষ হইতে এই সহরেই বাস করিয়া চামড়ার কারবার করিতেছেন। এইরূপ পৃথিবীসুদ্ধ জাতির শ্বশুর হইবার গৌরব অন্যত্র দুর্ল্লভ হইলেও এখানে অতিশয় সুলভ। তত্রাচ, প্রতিবারেই নাকি ভদ্রলোক সভয়ে প্রতিবাদ করিয়াছিলেন, কিন্তু মেয়েদের অপ্রতিহত স্বাধীনতা তাহাতে কান পর্য্যন্ত দেয় নাই। এক একদিন এক-একটি কন্যাকে বাটীর মধ্যে খুঁজিয়া পাওয়া গেল না, আবার এক-একদিন করিয়া তাহারা ফিরিয়া আসিল এবং সঙ্গে আসিল এই বিচিত্র জামাইয়ের দল। তাদের ভাষা আলাদা ভাব আলাদা, ধর্ম্ম আলাদা, মেজাজ আলাদা,—শিক্ষা, সংস্কার কাহারও সহিত কাহারও এক নয়,—এই যে দেশের মধ্যে ভারতের হিন্দু-মুসলমান প্রশ্নের মত ধীরে ধীরে এক অতি কঠিন সমস্যার উদ্ভব হইতেছে ইহার মীমাংসা হইবে কি করিয়া? ক্ষোভে, দুঃখে, ক্রোধে, বিরক্তিতে সে মনে মনে লাফাইতে লাগিল, এবং মেয়েদের এই সামাজিক স্বাধীনতাকেই একশবার করিয়া বলিতে লাগিল, এ হইতেই পারে না, এখন কিছুতেই চলিবে না। বর্ম্মা নষ্ট হইতেছে, ইউরোপ উচ্ছন্ন যাইতে বসিয়াছে—সেই ধার করা ভ্যতা আমাদের দেশেও আমদানী করিলে আমরা সমূলে মরিব। আমাদের সমাজ যাঁহারা গড়িয়াছিলেন, নারীকে তাঁহারা চিনিয়াছিলেন, তাই ত এই সতর্ক বিধি-নিষেধ। ইহা কঠোর হউক, কিন্তু কল্যাণে পরিপূর্ণ। এ দুর্দ্দিনে যদি না তাঁহাদের অসংশয়ে ধরিয়া থাকিতে পারি ত মৃত্যু হইতে কেহই আমাদের বাঁচাইতে পারিবে না। এমনি ধারা কত কি সে সেই অন্ধকারে একাকী বসিয়া আপন মনে বলিয়া চলিতে লাগিল। কিন্তু হায় রে! সোজা কথাটা তাহার মনে একবারও উদয় হইল না যে, যে মুক্তিমন্ত্রকে সে এ-জীবনে একমাত্র ব্রত বলিয়া কায়-মনে গ্রহণ করিতে চাহিতেছে, তাহারই আর এক মূর্ত্তিকে সে দুই হাতে ঠেলিয়া মুক্তির সত্যকার দেবতাকেই সসম্মানে দূর করিয়া দিতেছে। মুক্তি কি তোমার এমনই ছোট্ট একটুখানি জিনিস? তাহাকে কি তোমার আরামে চোখ বুজিয়া স্নান করিবার চৌবাচ্চা স্থির করিয়া বসিয়া আছ? সে সমুদ্র—আছেই ত

৬০