পাতা:পথের দাবী - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/৬৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

না, তুমি যদি একটু কষ্ট করে জিনিসগুলো তুলে দিয়ে যাও তোমাকে তার দাম দেব। তাহার স্নিগ্ধ কথায় খুশী হইয়া গাড়োয়ান জিনিস আনিতে গেল।

 সমস্ত আসিয়া পড়িলে ভারতী পথের দিকের ঘরটার মেঝের উপর পরিপাটি করিয়া নিজের হাতে বিছানা করিয়া দিয়া কহিল, এইবার, স্নান করে আসুন।

 অপূর্ব্ব কহিল, সমস্ত ব্যাপারটা আগে আমাকে খুলে বলুন।

 ভারতী কলের ঘরটা দেখাইয়া দিয়া মাথা নাড়িয়া বলিল, না, আগে স্নান করে আপনার সন্ধ্যে-আহ্নিকগুলো সেরে আসুন।

 অপূর্ব্ব জিদ্ করিল না। খানিক পরে সে স্নান প্রভৃতি সারিয়া আসিলে ভারতী একটু হাসিয়া বলিল, আপনার এই গেলাসটা নিন, জানালায় উপরে কাগজে মোড়া ওই চিনি আছে নিয়ে আমার সঙ্গে কলের কাছে আসুন, কি করে সরবৎ তৈরি করিতে হয় আমিই শিখিয়ে দিই। চলুন।

 অধিক বলার প্রয়োজন ছিল না, তৃষ্ণায় তাহার বুক ফাটিতেছিল, সে নির্দ্দেশ মত সরবৎ তৈরি করিয়া পান করিল এবং একটু নেবুর রস হইলে আরও ভাল হইত তাহা নিজেই কহিল।

 ভারতী বলিল, আপনাকে যে আরও একটা দুঃখ আমাকে দিতে হবে, বলিয়া সে মুখের দিকে চাহিয়া রহিল।

 অপূর্ব্বর সেই ছুটির দিনের কথাবার্ত্তা কাজ-কর্ম্মের ধরণ-ধারণ মনে পড়িয়া নিজেরও কথা কথা যেন সহজ হইয়া পড়িল, জিজ্ঞাসা করিল, কি রকম দুঃখ?

 ভারতী কহিল, নীচে থেকে আমি কয়লা এনে রেখেচি, টেলিগ্রাম পেয়ে সুমুখের বাড়ির উড়ে ছেলেটিকে দিয়ে আপনার সেই লোহায় উনুনটি মাজিয়ে ধুইয়ে নিয়েচি, চাল আছে, ডাল আছে, আলু, পটল, ঘি, তেল, নুন, সমস্ত মজুত আছে,—পেতলের হাঁড়িটা এনে দিচ্চি। আপনি শুধু একটু জল দিয়ে ধুয়ে নিয়ে চড়িয়ে দেবেন এই বলিয়া সে মুখের দিকে চাহিয়া রহিল।

শক্ত কাজ নয়। আমি সমস্ত দেখিয়ে দেব, আপনি শুধু চড়াবেন আর নামাবেন। আজকের মত এই কষ্টটি করুন, কাল অন্য ব্যবস্থা হবে।

 তাহার কণ্ঠস্বরের ঐকান্তিক ব্যাকুলতা অপূর্ব্বকে হঠাৎ যেন একটা ধাক্কা মারিল। সে ক্ষণকাল মৌন থাকিয়া জিজ্ঞাসা করিল, কিন্তু আপনার খাবার ব্যবস্থা কি রকম হয়? কখন বাসায় যান?

 ভারতী কহিল, বাসায় নাই গেলাম, কিন্তু আমাদের খাবার ভাবনা আছে নাকি? এই বলিয়া সে কথাটা উড়াইয়া দিয়া প্রয়োজনীয় জিনিসগুলি আনিতে তাড়াতাড়ি নীচে নামিয়া গেল।

৬৪