পাতা:পথের দাবী - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/৭০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

 ভারতী কহিল, তার চেয়েও বড় দুর্ঘটনা হঠাৎ মা যখন মারা গেলেন—

 মা মারা গেছেন? অপূর্ব্ব স্তব্ধ অসাড় হইয়া বসিয়া রহিল। নিজের মায়ের কথা মনে পড়িয়া তাহার বুকের মধ্যে কি একরকম করিতে লাগিল যা কখনো সে পূর্ব্বে অনুভব করে নাই। ভারতী নিজেও জানালার বাহিরে মিনিট-দুই নিঃশব্দে চাহিয়া থাকিয়া অশ্রু সংবরণ করিল। মুখ ঘুরাইতে গিয়া দেখিল অপূর্ব্ব সজলচক্ষে তাহার প্রতি একদৃষ্টে চাহিয়া আছে। আবার তাহাকে জানালার বাহিয়ে চোখ ফিরাইয়া চুপ করিয়া বসিয়া থাকিতে হইল। কাহারো কাছেই অশ্রুপাত করিতে তাহার অত্যন্ত লজ্জা করিত। কিন্তু আপনাকে শান্ত করিয়া লইতেও তাহার বিলম্ব হইত না, মিনিট দুই-তিন পরে ধীরে ধীরে বলিল, তেওয়ারী বড় ভাল লোক। আমার মা অনেকদিন থেকেই শয্যাগত ছিলেন, যে কোন সময়েই তাঁর মৃত্যু হতে পারে আমরা সবাই জানতুম। তেওয়ারী আমাদের অনেক করেচে। আমরা চলে যাবার সময় সে কাঁদতে লাগলো, কিন্তু এত ভাড়া আমি কোথা থেকে দেব?

 অপূর্ব্ব নীরবে শুনিতে লাগিল। ভারতী হঠাৎ বলিয়া উঠিল, আপনায় সেই চুরি ধরা পড়েছে, টাকা, বোতাম পুলিশে জমা আছে আপনি খবর পেয়েচেন?

 কই না!

 হাঁ, ধরা পড়েচে। ওকে যারা সেদিন তামাসা দেখাতে নিয়ে গিয়েছিল তাদেরই দল। আরও কার কার চুরি করার পরে, বোধ হয় ভাগাভাগি নিয়ে বনিবনা না হওয়াতেই একজন সমস্ত বলে দিয়েচে। এক চেঠির দোকানে যা কিছু জমা রেখেছিল পুলিশ সমস্ত উদ্ধার করেছে। আমি একজন সাক্ষী, এইখানে সন্ধান নিয়ে তারা একদিন আমার কাছে উপস্থিত—সেই খবরটা দিতে এসেই ত দেখি এই ব্যাপার। কবে মকদ্দমা ঠিক জানি নে, কিন্তু সমস্ত ফিরে পাওয়া যাবে শুনেছি।

 এই শেষ কথাটা হয়ত সে না বলিলেই পারিত, কারণ লজ্জায় অপূর্ব্বর মুখ শুধু আরক্তই হইল না, এই ব্যাপারে নিজের সেই সকল ব্যক্ত ও অব্যক্ত ইঙ্গিতগুলা মনে করিয়া তাহার গায়ে কাঁটা দিল। কিন্তু ভারতী এ সব লক্ষ্য করিল না, বলিতে লাগিল, ভেতর থেকে দোর বন্ধ, কিন্তু হাজার ডাকাডাকিতেও কেউ সাড়া দিলে না। আমাদের উপরের ঘরের চাবিটা আমার কাছে ছিল, খুলে ভিতরে গেলাম। মেঝেতে আমার একটা প্রসিদ্ধ ফুটো আছে—বলিয়া সে একটুখানি লজ্জার মৃদু হাসি গোপন করিয়া কহিল, তার মধ্যে দিয়ে আপনার ঘরের সমস্ত দেখা যায়, দেখি সমস্ত জানালা বন্ধ, অৎকারে কে একজন আগাগোড়া মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে,—তেওয়ারী বলেই বোধ হ’ল। সেই ফুটো দিয়ে চেঁচিয়ে একশ’বার বললাম, তেওয়ারী, আমি, আমি ভারতী, কি হয়েচে? দোর খোল। নিচে এসে আবার

৬৬